বাংলাদেশের জন্য এটা সুখবর যে, বিদেশি ঋণনির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমছে। তবে এখনও উন্নয়ন বাজেটে অর্থায়নের একটা অংশ বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মোকাবিলায় এবারও বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ নজর দিচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্যে বেশির ভাগ বড় প্রকল্প বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ফলে চলমান প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখা ও করোনা প্রতিরোধসহ অন্য প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বেশি বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির প্রত্যাশা করছে সরকার।
আগামী বাজেটে বিদেশি ঋণের লক্ষ্য ৮৯ হাজার কোটি টাকা ধরা হবে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এটা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি- দুটি উৎস থেকে বাজেটে অর্থায়ন করে সরকার।
বর্তমানে উন্নয়ন বাজেটে বা এডিপির প্রায় ৩২ শতাংশ আসে বিদেশি ঋণ থেকে। বিভিন্ন প্রকল্পে এ ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা। এর বাইরে বাজেট সহায়তাও দিয়ে থাকে তারা।
স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম যুগের বাজেটগুলোয় ৯৮ শতাংশ সম্পদের জোগান আসত বিদেশি উৎস থেকে। নব্বই দশকের পর বিশ্বায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ উদারীকরণের ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হতে থাকে। ফলে আমাদের নিজস্ব সম্পদ আহরণের সক্ষমতা ক্রমান্বয়ে বাড়ে এবং বিদেশি ঋণনির্ভরশীলতা কমতে থাকে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নিবার্হী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজেট অর্থায়নে বিদেশি ঋণের নির্ভরশীলতা কমলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার দরকার রয়েছে এখনও। বিদেশি ঋণের অংশ আরও কমিয়ে আনতে হলে আমাদের নিজস্ব সম্পদ তথা রাজস্ব আদায়ে আরও বেশি জোর দিতে হবে।’
চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের অংশ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩২ শতাংশ জোগান আসছে বিদেশি উৎস থেকে। এ জন্য বাজেট বাস্তবায়নে এখনও বিদেশি ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিদেশি ঋণের ইতিবাচক দিক হলো অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে এই ঋণ সস্তা। সুদের হার ১ শতাংশের নিচে এবং ২০ থেকে ৩০ বছরে পরিশোধ করা যায়। নেতিবাচক দিকও আছে। অর্থ ছাড়ে জটিলতা ও ঋণ পেতে নানা শর্ত মানতে হয়।
উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। আর একক দেশ হিসেবে জাপান থেকে সর্বোচ্চ ঋণ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিশ্রুতি আর প্রাপ্তির মধ্যে বিরাট ফারাক
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে যা প্রতিশ্রুতি থাকে, তা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ ছাড় না হওয়ায় পাইলাইনে বিদেশি ঋণের পাহাড় জমেছে। বর্তমানে পাইপলাইনে (অব্যবহৃত ঋণ) বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি (৪০ বিলিয়ন) ডলার।
মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালায়গুলো কাঙ্ক্ষিত হারে বিদেশি ঋণ ব্যবহার করতে পারছে না বলে মনে করেন ইআরডির কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর তা শুরু হতেই দুই-তিন বছর লেগে যায়। তাহলে টাকা খরচ হবে কীভাবে? এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের টাকা খরচ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
ইআরডিরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, এখন পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত যে পরিমাণ ঋণ পাইপলাইনে জমা হয়ে আছে, তা কমিয়ে আনতে প্রতিবছর কমপক্ষে ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচ করা উচিত।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ খরচ করতে পারছে। বাকি অর্থ পাইপলাইনে অলস পড়ে থাকছে। তাই বৈদেশিক ঋণের প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, খরচ করতে না পারলেও বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এ জন্য প্রতিবছর বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি টাকার তুলনায় উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ খরচের প্রবণতা কম।
চলতি অর্থবছরের এডিপির আওতায় জুলাই থেকে মার্চ– এ ৯ মাসে সরকারি অর্থ খরচ হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ থেকে খরচ হয়েছে সাড়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করে সহায়তাকারী দেশ বা সংস্থার মর্জির ওপর। তারা টাকা ছাড়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত দেয়। ওই শর্ত পূরণ করতে পারলে টাকা ছাড় হবে। আর না করতে পারলে হবে না। এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।