বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রভাতীর এভাবে দাম বাড়ার কারণ ‘আল্লাহ জানেন’

  •    
  • ২ মে, ২০২১ ১২:১৭

প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব নিজেই এভাবে দাম বৃ্দ্ধিকে ‘হাস্যকর’ বলেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দর বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কাছে অপ্রকাশিত কোনো তথ্য নেই। সম্প্রতি আমরা আমাদের প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ করেছি। এর বাইরে কোম্পানির কোনো অগ্রগতি নেই।’ তাহলে শেয়ারের দর এভাবে কেন বাড়ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা আল্লাহ জানেন। বর্তমানে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের যে দর তা অযৌক্তিক।’

পুঁজিবাজারে সাধারণ বিমা খাতের বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদর যখন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে, তখনও আলাদা করে বলতে হয় প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের কথা। গত বছরের মার্চে ২০ টাকার আশপাশে থাকা কোম্পানির শেয়ারদর ১৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তা-ও সম্প্রতি ১৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয় হয়েছে। সেই হিসাবে শেয়ারের দর ২০০ টাকার আশপাশে। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে শেয়ারের দর ১০ গুণ হয়ে গেছে।

প্রভাতীর এমন বিপুল বিক্রমে ছুটে চলায় অবাক খোদ কোম্পানি সচিব‍ সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এভাবে দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। কেন বাড়ছে, সেটা আল্লাহ জানেন।

গত বছর করোনা সংক্রমণের কারণে ৬৬ দিন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকে। লেনদেন চালু হওয়ার পর বিমা খাতে চলতি লকডাউন চলাকালের মতোই উল্লম্ফন দেখা গেছে।

সে সময়ও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর তিন থেকে আট গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। প্রভাতীর দরও সে সময় ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার কমতে কমতে নামে ৭০ টাকার আশপাশে।

গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি ২০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার ঘোষণা দেয়। এর চেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করা কোম্পানির শেয়ারদরে নড়চড় না হলেও প্রভাতীতে যেন আগুন লেগে যায়।২২ মার্চ দাম ছিল ৭১ টাকা ৪০ পয়সা। মাত্র পাঁচ সপ্তাহে দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ২৯ এপ্রিল দাঁড়ায় ১৬৩ টাকা ২০ পয়সা। ১৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয় হওয়ার কারণে মাঝে একদিন দাম কিছুটা কমেছিল। সেটা হিসাব না করলে দাম দাঁড়ায় ১৯১ টাকা।

গত তিন মাসে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের দাম বাড়ার চিত্র

এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লকডাউনের মধ্যে। ৫ এপ্রিল লকডাউন শুরুর দিন প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর ছিল ৯৫ টাকা ৪০ পয়সা। ১৮ কার্যদিবসে দাম বেড়ে হয় প্রায় দ্বিগুণ।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ মনে করেন গোটা বিমা খাত নিয়েই কারসাজি হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি এ ক্ষেত্রে জোরাল কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

যদিও দর বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসই।গত বছর ২ জুলাই ১৯ টাকা ৪০ পয়সা থেকে এক বছরেরও কম সময়ে ১০ গুণ দাম হয়ে যাওয়ার পেছনে কোম্পানির কাছে মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য আছে কি না, সেটি জানতে চাওয়া হয়েছে এই চিঠিতে।

গত ছয় মাসে প্রভাতির দাম বাড়ার চিত্র

কী বলছেন কোম্পানি সচিব?

প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব নিজেই এভাবে দাম বৃ্দ্ধিকে ‘হাস্যকর’ বলেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দর বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কাছে অপ্রকাশিত কোনো তথ্য নেই। সম্প্রতি আমরা আমাদের প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ করেছি। এর বাইরে কোম্পানির কোনো অগ্রগতি নেই।’

তাহলে শেয়ারের দর এভাবে কেন বাড়ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা আল্লাহ জানেন। বর্তমানে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের যে দর তা অযৌক্তিক।’

ডিএসইরি চিঠি পেয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দর বাড়লেই ডিএসই চিঠি দেয়। আমরা তার উত্তর দিই। তবে আর্থিক প্রতিবেদনের বাইরে কোম্পানির কোনো তথ্য নেই। আমাদের ব্যবসা ভালো চলছে।’

গত এক বছরে প্রভাতি ইন্স্যুরেন্সের দাম বাড়ার চিত্র

বিএসইসির ভাবান্তর নেই

প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের দর অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না, সেটি এখন পর্যন্ত খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। যদিও এর আগে সংস্থাটি কোনো ধরনের কারসাজির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।

প্রভাতীর বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কোম্পানির দর বাড়ার কারণ হচ্ছে সে কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ। বিএসইসির এখানে কিছুই করার নেই। বরং এই দর বাড়ার পেছনে কোনো কারসাজি বা ম্যানুপোলেট আছে কি না সেটি দেখার দায়িত্ব বিএসইসির। তবে আমরা এখন পর্যন্ত তেমন কিছু পাইনি।’

প্রভাতীর লভ্যাংশের ইতিহাস

২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির লভ্যাংশের ইতিহাস কখনও তেমন একটা ভালো ছিল না।

২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লভ্যাংশ হিসেবে ১২ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে কোম্পানিটি।২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ৬ শতাংশ বোনাসের পাশাপাশি শেয়ার প্রতি ৬০ পয়সা করে নগদ লভ্যাংশ দেয়া হয়।

পরের দুই বছর শেয়ার প্রতি এক টাকা করে নগদ এবং ২০১৯ সালে এক টাকা ২০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ দেয়া হয়।

গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি তিন টাকা ১০ পয়সা আয় এখন পর্যন্ত ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তার আগের বছর শেয়ার প্রতি আয় ছিল ২ টাকা ৩৮ পয়সা।২০১৮ সালে শেয়ার প্রতি এক টাকা ৭৭ পয়সা, ২০২৭ সালে ৭৪ পয়সা, তার আগের বছর এক টাকা ৮১ পয়সা এবং ২০১৫ সালে এক টাকা ৯১ পয়সা আয় করে কোম্পানিটি।

গত দুই বছরে দাম বাড়ার চিত্র

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় দাঁড়িয়েছে এক টাকা ২৬ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা ৩৪ পয়সা।

এই হিসাবে যদি আগামী তিন প্রান্তিকে সমপরিমাণ আয় করতে পারে কোম্পানিটি, তাহলেও বছর শেষে আয় হবে পাঁচ টাকা ৪ পয়সা। কোম্পানির পি রেশিও এখন ৩৫। অর্থাৎ কোম্পানির শেয়ারের যে দর, সে পরিমাণ টাকা আয় করতে এই হিসাবেও কোম্পানির লেগে যাবে ৩৫ বছর।অথচ পুঁজিবাজারে অন্তত ৩৫টি ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড আছে, যেগুলোর পি রেশিও ১০ এর নিচে।

অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে আরও কিছু বিমার দর

অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৬১ টাকা ১০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ারদর ছিল ৩৬ টাকা ২০ পয়সা। লকডাউনে কোম্পানিটির শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৬৮.৭৮ শতাংশ।

ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৫৪ টাকা ৫০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ারদর ছিল ৩৩ টাকা ৯০ পয়সা। কোম্পানিটির শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৬০.৭৬ শতাংশ।

ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ারদর ছিল ৪৬ টাকা ১০ পয়সা। কোম্পানিটির শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৭০.৭১ শতাংশ।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৫২ টাকা ৯০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ারদর ছিল ৩২ টাকা ৮০ পয়সা। কোম্পানিটির শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৬৩.৭১ শতাংশ।

ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৩০ টাকা ৮০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ার দর ছিল ১৮ টাকা ১০ পয়সা। কোম্পানিটির শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৭০.১৬ শতাংশ।

সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান শেয়ারদর ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা। ৫ এপ্রিল শেয়ারদর ছিল ২১ টাকা ৩০ পয়সা। কোম্পানিটি শতকরা হিসাবে দর বেড়েছে ৭১.৩৬ শতাংশ।

বিমার দর বাড়ায় যেসব তথ্য

গত বছর বিমা কোম্পানির শেয়ারে দরবৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু গুজব কাজ করছিল। এজেন্টের কমিশন কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ, গাড়ির তৃতীয় পক্ষের বিমা বাতিল করে প্রথম পক্ষের বিমা চালু হলে আয় বাড়বে, লভ্যাংশ বাড়বে, এমন কথা বলাবলি হয়।

এরপর আলোচনায় আসে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় বড় প্রকল্প বিমার আওতায় আসছে। এগুলোর ঝুঁকি একেবারেই কম; কোম্পানির লাভ হবে ভালো। তবে পরে জানানো হয়, মেট্রোরেল সরকারি সাধারণ বিমা করপোরেশনের আওতায় থাকবে। এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়।

আবার ১০ বছর আগে করা একটি বিধান সামনে আনা হয়, যেখানে বলা ছিল, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ থাকতে হবে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। এমনটি হলে বিমা কোম্পানির শেয়ার মালিকদেরই কিনতে হবে।

কিন্তু আয় বা লভ্যাংশ বাড়ার গুজব সত্য প্রমাণ হয়নি। পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ নিজেদের হাতে রাখার যে আইন করা হয়েছে, সেটিও কার্যকর হয়নি। তবু আবার ঢালাও দর বৃদ্ধিতে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে।

সব শেষ সোমবার বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে জারি করা আরেক নির্দেশনা এই খাত দিয়ে আগ্রহ আরও বাড়িয়েছে।

সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ১ অক্টোবরের পর থেকে কোনোভাবেই প্রিমিয়াম জমার বিপরীতে হাতে লেখা রশিদ দেয়া যাবে না।

২৬ এপ্রিল এই নির্দেশনা জারির পরদিন মূল্য সংশোধন হয় বাজারে। কিন্তু বিমা কোম্পানির শেয়ার দর থাকে তেজী।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ সেদিন নিউজবাংলাকে বলেন, এই নির্দেশনা কেন শেয়ার দরে প্রভাব ফেলবে সেটি বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, ‘বিমা খাত নিয়ে কারসাজি হচ্ছে এটা অনেক আগে থেকেই। কারণ, পুঁজিবাজারে অনেকগুলো খাত থাকলেও এ খাতের শেয়ারে কেন বিনিয়োগকারীদের এত আগ্রহ থাকবে? এটি শক্তভাবে মনিটরিং করা উচিত।’

এ বিভাগের আরো খবর