সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার পর টানা ১৪ কার্যদিবস কমেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শেয়ার খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডর (কেপিসিএল) দাম। এক দিনে যত কমা সম্ভব, ততই দর হারিয়েছে কোম্পানিটি।
৪৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে দাম একপর্যায়ে নেমে এসেছিল ৩১ টাকা ৯০ পয়সায়। তবে গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার দাম এক লাফে ৩ টাকা ১০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা।
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল তিনটি। তবে ২০১৮ সালেই মেয়াদ শেষ হয়ে যায় একটির। বাকি দুটির মেয়াদও শেষ হচ্ছে চলতি মে মাসে। আর এখন সবেধন নীলমণি হিসেবে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পায়রার ৪৫ শতাংশের মালিকানার আয় কী হবে, তার ওপর নির্ভর করতে হবে শেয়ারধারীদের।
ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর ৮ এপ্রিল এ কারণেই কম দামে হলেও শেয়ার ছেড়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রথম দিন ১০ শতাংশ দাম কমলেও দ্বিতীয় কার্যদিবস থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ দাম কমতে পারবে বলে জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। আর ঘটেছেও তা-ই।
তবে এর মধ্যে আরেক খবরে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। কেপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়াতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সুপারিশ করেছে এমন খবরে এক দিনেই দাম বাড়ে ১০ শতাংশ।
বিএসইসি দাম কমার ক্ষেত্রে ২ শতাংশের প্রান্তসীমা নির্ধারণ করলেও বাড়ার ক্ষেত্রে আগের মতোই ১০ শতাংশ বাড়বে পারবে বলে জানিয়েছে।
এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তাদের দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সেখানে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএসই) আগের বছরের একই সময়ে কমেছে ১৯ পয়সা।
আর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৩৯ পয়সা।
তবে অনিশ্চয়তার মধ্যেও কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো বার্তা দেয়া হচ্ছে না।
ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্ট
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে কেপিসিএলের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা সোহরাব আলী খান বলেন, ‘দুটি প্লান্টের লাইসেন্সের মেয়াদের বিষয়ে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা হয়েছে। আশা করি নবায়ন হবে।’
যদি না হয়, তাহলে কী করবেন- এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আশা করি হবে।’
কোম্পানির তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য
খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের হাতে ছিল তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে একটির মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হওয়ায় আর নবায়ন করা হয়নি।
বাকি দুটির মধ্যে খানজাহান আলী পাওয়ার লিমিটেডের ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ মে। আর খুলনা পাওয়ার কোম্পানি ইউনিট টু ১১৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ২৮ মে।
এই দুটি বন্ধ হয়ে গেলে কেপিসিএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পায়রা প্লান্টই বিনিয়োগকারীদের একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে থাকবে।
গত ২১ জানুয়ারি ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পটুয়াখালীর খোলিশখালীতে অবস্থিত এই কেন্দ্র থেকে ১৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এখানে কেপিসিএলের মালিকানা ৩৫ শতাংশ।
বিএসইসির বৈঠক নিয়েও বক্তব্য নেই
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগের মধ্যে কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে গত ২৩ মার্চ বিএসইসি কার্যালয়ে ডাকা হয় কেপিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। তারা বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এর সঙ্গে বৈঠক করেন ।
তবে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি কোনো পক্ষই।
বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের যে দুটি প্লান্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেগুলোর লাইসেন্স হয়েছে কি না, আর হবে কি না, সেটি বলতে পারবে বিপিডিবি। তবে আমরা লাইসেন্স নবায়নের অনুরোধ করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছি। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কমিশন কাজ করছে।’
চিঠির পর কী হলো, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অগ্রগতি কী, সেটি ডিএসইর নিউজে কোম্পানিটি জানাবে। তবে এ মুহুর্তে কোম্পানিটির অগ্রগতির কোনো তথ্য নেই।’
শেয়ার নিয়ে হতাশা
২০১০ সালে চাঙা পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি হয় গড়ে ১৯৪ টাকা করে। ছয় বছর বোনাস শেয়ার দিয়ে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩৯৭ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার।
চলতি বছরের জানুয়ারি ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ বা ১ কোটি ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগাকরীরা। যার পুরোটা কিনেছে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা।
ফলে এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির মোট শেয়ারের ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ আর ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ফলে বর্তমানে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর নবায়ন না হয়, তাহলে এরা সবাই অনিশ্চয়তায় পড়বেন।
লভ্যাংশের পরিসংখ্যান
কোম্পানিটি ২০১০ সালের। তালিকাভুক্তির বছরে ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করে।
এরপর ২০১০ সালের জন্য ২০ শতাংশ, ২০১১ সালের জন্য ২৫ শতাংশ, ২০১২ সালের জন্য ১২.৫ শতাংশ, ২০১৩ সালের জন্য ৫ শতাংশ এবং ২০১৮ সালের জন্য আবার ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করা হয়।
১৯৪ টাকা ভিত্তি ধরে ১০ বছরের বোনাস শেয়ার হিসাব করলে দাম দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৫৫ পয়সা।
পাঁচ বছর ধরে নগদ লভ্যাংশের দিকে জোর দেন কোম্পানির উদ্যোক্তারা। ২০১৬ সালে ৭৫ শতাংশ (শেয়ারপ্রতি সাড়ে সাত টাকা), ২০১৭ সালে ৫৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০২০ সাল ৩৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কেপিসিএল।