সারা বছরই চলছে রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ-ব্যবস্থার উন্নয়নকাজ। এসব কাজে ঠিকাদারের বিল বাবদ কোটি কোটি টাকা ছাড় করা হয়। কিন্তু দিনমজুর-শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাঙাগড়ার এসব কাজে হাড়ভাঙা শ্রম দিলেও মেলে না ন্যায্য মজুরি।শ্রম আইনের প্রয়োগ না থাকায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। মেধা বা দক্ষতা নয়, শ্রমিকের ভাগ্যের নাটাই ঘুরছে মালিকের ইচ্ছায়।
রাজধানীর নয়াটোলায় সম্প্রতি কয়েকজন শ্রমিককে অস্থায়ী এক কাজে ঘাম ঝরানো শ্রম দিতে দেখা গেছে। যেখানে পুরুষদের মজুরি ছিল ৪০০ টাকা; নারীদের ৩৫০ টাকা।
শ্রমিক আবুল হাসেম, আনোয়ারা, বিলকিস বানু ও লাভলী বেগম জানান, তারা যে শ্রম দেন, তাতে ন্যায্য মজুরি হওয়া উচিত ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। একই দশা সারা দেশের সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারকাজেও।
কাজ অনুযায়ী মজুরি কম পাওয়ার তথ্য দেন হাতিরঝিল এলাকার ঝিলপাড়ের একটি হোটেলের শ্রমিক কুমিল্লার কাইয়ুমও। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এক বেলা খাবারসহ তার মাসিক বেতন দেয়া হয় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। কাকডাকা ভোরে কাজ শুরু হয় তার, সারা দিনের শ্রম শেষ হয় মধ্যরাতে।
দিনমজুর-শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাঙাগড়ার কাজে হাড়ভাঙা শ্রম দিলেও মেলে না ন্যায্য মজুরি। ছবিটি রাজধানীর শ্যামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
মজুরি বাড়ানোর দাবি জানালেও মালিক নানান অজুহাতে কার্যকর করছেন না। এ চিত্র সারা দেশের অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁয়।
ওয়ার্কশপ শ্রমিক মোহাম্মদ সুজন ও রবীন্দ্র মজুমদার জানান, এই প্রকৌশল কাজে তারা যে শ্রম দিচ্ছেন, সেখানে কায়িক শ্রমের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ও রয়েছে। ঝুঁকি তো আছেই। কিন্তু সে অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন সামান্যই। থাকা-খাওয়ার খরচ মালিক বহন না করে মাসিক বেতন ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৮ হাজার ও ১০ হাজার টাকা।ছোট শিল্পকারখানা, টেইলার্স, ইটভাটা, তাঁত, প্রিন্টিংসহ বিভিন্ন খাতে একইভাবে কাজ করছেন শ্রমিক-কর্মচারাীরা।
এভাবে স্থায়ী-অস্থায়ী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা খাতে নানাজনের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি, যার মূল কারিগর হচ্ছেন এসব শ্রমিক।
প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যে প্রাণের সঞ্চার, তার সর্বত্রই রয়েছে শ্রমিকের অক্লান্ত শ্রম, ঘাম ও উৎপাদনের অদম্য নেশা।
মূলত এই কারিগরদের হাড়ভাঙা শ্রমের ওপর ভর করেই স্বাধীনতা-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপের সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। পেয়েছে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি; দেখছে মধ্য আয়ের স্বপ্ন।
অপেক্ষা উন্নত দেশে যাত্রার। দেশে এখন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও পায়রা বন্দরের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পের কাজ চলছে। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কের নিয়মিত উন্নয়ন ও সংস্কার তো চলছেই। শিল্পায়নেও পিছিয়ে নেই। সব মিলিয়ে দেশ এগিয়েছে অনেক দূর।
কিন্তু দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি যাদের হাত ধরে এসেছে, সেই উন্নয়ন কারিগরদের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কারণ, এখনও তাদের ভাগ্যের নাটাই ঘুরছে কাজে দক্ষতায় নয়, মালিকের মর্জিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই এ খাতে নিয়োজিত। আর ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
অন্যদিকে কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। শিল্প খাতের ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ, সেবা খাতের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত।গ্রাম ও শহরে কৃষি, চিংড়ি-মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট কাজ, চাতাল, ওয়েল্ডিং, বিড়ি কারখানা, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কর্ম, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি কর্ম, কুলি, দিনমজুর, ছোট ম্যানুফ্যাকচারিংসহ এমন বিভিন্ন খাত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিকের তুলনায় এসব খাতে মজুরিবৈষম্য প্রকট। আছে জেন্ডার-বৈষম্যও। একই কাজে সমমানের শ্রম দেয়া সত্ত্বেও নারী শ্রমিকরা সমান মজুরি পাচ্ছে না।সেই শ্রমিক, যে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে। সে অর্থে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশায় কর্মজীবী সবাই শ্রমিক হিসেবে গণ্য হলেও শ্রম অধিকারের সংজ্ঞায় শ্রমিক বলতে শুধু সর্বনিম্ন মজুরির প্রান্তিকজনকেই বোঝানো হয়েছে।শ্রমিকদের দাবি, আইনগতভাবে রাষ্ট্র তাদের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা দিলেও মিলছে না। মালিকদের অতি মুনাফা, লোভ ও শ্রমিককল্যাণে অর্থ ব্যয়ের বাড়তি দায় নেয়ার মানসিকতা না থাকায় তারা বঞ্চিতই থাকছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা শ্রমিকরাও পাচ্ছে। তাও তারা দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার-সুশীলদের চাপে এবং নিজেদের ব্যবসা রক্ষার তাগিদেই।
শ্রম পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শ্রমিকরা শ্রম দিচ্ছে দেশে এমন খাতের সংখ্যা ৬৩টি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫৪টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সব খাত তা মানছে না।
দিনমজুর-শ্রমিকরা ভাঙাগড়ার কাজে হাড়ভাঙা শ্রম দিলেও মেলে না ন্যায্য মজুরি। ছবিটি রাজধানীর শ্যামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
বিলসের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় এক ঘণ্টা কাজ করলে একজন শ্রমিক ৭ ডলার মজুরি পান। অস্ট্রেলিয়ায় তা পান ২ ডলার। অন্যান্য দেশেও প্রতি ঘণ্টার মজুরি কম-বেশি এই হারের কাছাকাছি। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে। দিনের পুরো কর্মঘণ্টার মজুরিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে ৪-৫ ডলারে সীমাবদ্ধ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন, দেশে শ্রমিকের জীবনমান, কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশসহ সবদিক এখনও অপ্রাতিষ্ঠানিক রয়ে গেছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে সব খাতের শ্রমিকের জীবনমান উন্নতির কথা ভাবতে হবে। বাস্তবতা হলো, কর্মক্ষেত্রে নেয়ার আগে তাদের যে প্রতিশ্রতি দেয়া হয়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু এ খাতের শ্রমিকেরা শ্রম আইনের বাইরে থাকায় তারা কোনো ধরনের শ্রম অধিকার পাচ্ছে না।
‘যেকোনো সময় ইচ্ছে করলেই তাদের কাজ থেকে বের করে দেয়া যায়। এ প্রবণতা এখন প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও শুরু হয়েছে। খরচ বাঁচাতে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্লিনার ও সিকিউরিটি গার্ডও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।’
তবে শ্রম অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) আব্দুল লতিফ খান জানান, যেসব খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রধান খাতগুলোয় তা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে। কিছু খাতে সুপারিশকৃত মজুরি পুরোপুরি বাস্তবায়ন নাও হয়ে থাকতে পারে। তবে মোটামুটি জীবনধারণের মতো একটা মজুরি কিন্তু শ্রমিকরা পাচ্ছে। সরকার শ্রমিকের স্বার্থে সে হারেই মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে।তিনি বলেন, ‘দেশ এগোচ্ছে। আরও এগোবে। আগামীতে শ্রমিক-কর্মচারীর স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে মালিকদের মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে।‘পাশাপাশি দক্ষতানির্ভর কাজে শ্রমিকদেরও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাস্তবায়ন তদারকি বাড়াতে শ্রম অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সক্ষমতার উন্নয়ন দরকার।’