রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত আট বছরে শিল্প খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের ব্যাপক উন্নতি বিশ্বজুড়ে নজর কাড়লেও শ্রম অধিকার ইস্যুতে এখনও অবহেলার গ্লানিমুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ প্রতিনিধিত্বশীল শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করছে, শ্রমিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিভিন্ন ধারায় যেসব নিয়মকানুন রয়েছে, তা মানছে না বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ।
শ্রম অধিকার ইস্যুতে সংশ্লিষ্টদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হলো বাংলাদেশ লেবার ইন্সপেকশন কনভেনশন ১৯৪৭,’ ‘দ্য ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব দ্য রাইট টু অর্গানাইজ কনভেনশন ১৯৪৮,’ এবং ‘দ্যা প্রটেকশন অব দ্যা রাইট টু অর্গানাইজ অ্যান্ড দ্যা কালেক্টিভ বার্গেইনিং কনভেনশন ১৯৪৯’ প্রতিপালন করছে না।
তারা আরও বলছে, তৈরি পোশাক খাতের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে আমাদের অন্যতম উদ্বেগের মধ্যে প্রধান একটি কারণ হলো এই শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন বাধ্যতামূলক অনুমোদন প্রদানের ধারণা। যেখানে বিদ্যমান আইনের মধ্যে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা। আবার প্রচলিত আইনও সঠিক কার্যকর হচ্ছে না।
কারণ সেখানে শ্রমিকরা তৈরি পোশাক কারখানায় ইউনিয়ন করার কারণে বরখাস্ত হওয়াসহ প্রতিনিয়ত অসৎ শ্রম আচরণের শিকার হচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়েও মৌখিক ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। যার প্রতিকারও মিলছে না।
ইতালি, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও ব্রাজিলের শ্রমিক প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের ১০৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করেছে।
তারা এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারেও জোরালো দাবি তুলেছে।
এদিকে শুধু বিদেশ নয়, স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনেরও একই রকম অভিযোগ। শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত পদক্ষেপের ঘাটতির প্রমাণ দেখতে পেয়েছে স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও।
জানা গেছে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন তৈরি হয়। এটি ২০১৩, ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হয়। প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের তথ্য বলছে, ২০০৬ সালে প্রবর্তিত শ্রম আইন, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে যে সংশোধনী আনা হয়, তার মাধ্যমে শ্রম আইনের ১৭৯ ও ১৮০ ধারার ক্ষমতাবলে পাওয়া ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার উল্টো সংকুচিত করা হয়েছে। ফলে এখনও শ্রমিকরা অসংগঠিত ও অসহায়।
সংগঠনটির আরও দাবি, শুধু তৈরি পোশাক নয়, হালকা যানবাহন, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, পরিবহন, মোটর মেকানিক, তাঁত, বিড়ি, জরি, পাদুকা, হকার ও দিনমজুর যারা অসংগঠিত খাতে কাজ করেন, তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাদের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা বলতে কিছু নেই।
অন্যদিকে পোাশাক খাতে ‘রানা প্লাজা পরবর্তী পরিবর্তন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানায়, রানা প্লাজা-পরবর্তী বেশির ভাগ উদ্যোগ শুধু কর্মস্থলের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক, শ্রম অধিকারসংশ্লিষ্ট উদ্যোগগুলোর অগ্রগতি আসলে কম। দেশের ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ কারখানায় কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই। যেগুলো আছে, তারা কার্যত দুর্বল অথবা অকার্যকর।
সলিডারিটি সেন্টার-বাংলাদেশের ‘সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা চর্চায় বাধা: ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের প্রতিবন্ধকতা-বিষয়ক সাক্ষ্যপ্রমাণ’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনেও দাবি করা হয়েছে, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত ৯৭ শতাংশ শ্রমিক এখনও ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে।
এ ছাড়া শ্রমিকরা শ্রম আইনের শর্ত মেনে ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন করলেও অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তাদের নিবন্ধনের আবেদন বাতিল করা হচ্ছে। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এমন সব শর্তের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে যা আইন বা বিধিসম্মত নয়।
গত ১৭ এপ্রিল ‘ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯ অন দ্য লেবার মার্কেট: পলিসি প্রপোজালস ফর ট্রেড ইউনিয়ন অন এমপ্লয়মেন্ট, জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি ফর সাসটেইনেবল রিকভারি’ শীর্ষক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) এবং সিপিডি পরিচালিত আরেকটি যৌথ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়।
এই সমীক্ষায় দাবি করা হয়, দেশে ৮ হাজার ৫৫১টি ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। সেখানে মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে সক্রিয়। বাকি ৯৬ শতাংশ শ্রমিকই ইউনিয়নভুক্ত নয়।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) আব্দুল লতিফ খান নিউজবাংলাকে জানান, এগুলো একটি প্রচলতি অভিযোগ। আসলে আইনগতভাবে যেগুলো হওয়ার তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়। এই হার ৯০ শতাংশের বেশি। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন কার্যক্রম সরকারই চালু করেছে।
তিনি বলেন, ‘আইনসম্মত না হলে তো তার অনুমোদন দেয়ার সুযোগ নেই। এরপরও আমরা দেখছি প্রক্রিয়াকে কীভাবে আরও সহজ করা যায়। যাতে আবেদনকারী সবাই ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পায়।’
এই সমীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে মতামত জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘আসলে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগের একটা অভাব রয়েছে। অংশীজনদের মধ্যকার এই যোগাযোগশূন্যতা কমিয়ে আনার জন্য ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
শ্রম অধিকার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একজন সুখী শ্রমিকই হতে পারে ভালো শ্রমিক। যে শ্রমিক প্রতিদিন ৩-৫ মাইল হেঁটে কারখানার কাজে আসে, তার কাছ থেকে আমরা কতটুকু উৎপাদনশীলতা আশা করতে পারি?’
সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের জরিপের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আট বছরে এক হাজার ৩১টি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শ্রম দপ্তর ৪৬ শতাংশ আবেদনই বাতিল করেছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ত্রয়োদশ অধ্যায় ‘ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্প সম্পদ’- ১৭৯ ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
কিন্তু আবেদনে প্রদত্ত ইউনিয়ন সদস্যদের স্বাক্ষরের সঙ্গে কারখানা থেকে দেয়া মজুরি বা বেতন শিটে সেসব সদস্যের স্বাক্ষরের সামান্য অমিল দেখা গেছে। ইউনিয়নের সদস্যরা নিয়োগকারী থেকে দেয়া কাগজপত্র যেমন, পরিচয়পত্র বা তার অনুলিপি দিতে না পারা, কারখানার পরিচয়পত্রের নম্বরের সঙ্গে কারখানার রেকর্ড বা দলিলপত্রের মিল না থাকা এবং কারখানায় প্রকৃত শ্রমিক সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ শ্রমিক সংখ্যা দেখানো, যেন ইউনিয়নের পক্ষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন নেই বলে দাবি করা যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ঘুষ লেনদেন ও রাজনৈতিক প্রভাবেও ট্রেড ইউনিয়ন প্রত্যাখ্যান হয়ে থাকে।
সেসব তথ্য থেকে জানা গেছে, পরিবহন খাতের মোট শ্রমশক্তির ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ ছাড়া নির্মাণ খাতের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ ও পাট খাতের ৪ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক ইউনিয়নভুক্ত। তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
তবে অভিযোগ আছে, ৫০ শতাংশ কারখানায় কোনো রেজিস্টার্ড ট্রেড ইউনিয়ন নেই। মাত্র ১০০টি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকর আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতোদিন নিরাপদ কারখানা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরব থাকলেও সরকার এখন শ্রম অধিকার ইস্যুতেও মনোযোগী হয়েছে। এ কারণে সংশোধিত শ্রম আইনের আপত্তিকর কিছু ধারা আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে ঝামেলামুক্তভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ রাখা হবে।
শ্রম অধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় করা অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিষ্কার করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে।
ওই চিঠিতে শ্রম সচিব আবদুস সালাম জানিয়েছেন, শ্রম আইন পর্যালোচনা (সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও নিয়ম), ফ্রিডম অফ অ্যাসোসিয়েশন, যৌথ দর কষাকষির অধিকার, শ্রম সংস্থার তালিকাভুক্তিকরণ এবং শ্রম আদালত সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে একটি সুষ্ঠু ও বাস্তবভিত্তিক পথ নকশার জন্য সরকার, মালিক প্রতিনিধি এবং দেশি-বিদেশি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে বসে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ সভার মাধ্যমে উত্তরণের চেষ্টা করছে। যার আলোচনা শুরু হয়েছে।
রানা প্লাজা ধস ও বৈশ্বিক চাপ
শিল্প দুর্ঘটনার ইতিহাসে বিশ্বে অন্যতম বড় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধস। এতে শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিয়ে মালিকপক্ষ ও সরকারের চরম উদাসীনতা বিশ্বজুড়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তখন শ্রমিক সুরক্ষার প্রশ্নে সরব হয় বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও।
জিএসপি স্থগিতকরাসহ নানারকম শর্ত চাপানো হয় বাংলাদেশের ওপর। এ ছাড়া শ্রমিকের রক্তমাখা পোশাক বর্জনের হুংকার দেয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ক্রেতা এবং তাদের ভোক্তারাও।
এভাবে চরম রোষাণলে পড়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয় তাদের দেয়া টাইমবাউন্ড কর্মসূচির মাধ্যমে পোশাকখাতে পরিস্থিতি উন্নয়ন করা হবে।
আট বছর পর এই সময়ে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে পোশাকখাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। দেশের সাড়ে প্রায় চার হাজার পোশাক কারখানার সবকটিই এখন আধুনিক।
বিশ্বের আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক সবুজ কারখানার লিড সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০টি কারখানার সাতটিই এখন বাংলাদেশে। স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ৫ শতাধিক কারখানা।
তা ছাড়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে পোশাক শিল্পে বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আবারও বাংলাদেশমুখী হয়েছে।