করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই শপিংমল ও দোকানপাট খোলা হলেও ক্রেতা প্রত্যাশার তুলনায় কম বলে দাবি করেছেন বিক্রেতারা।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণত বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি থাকে। তা ছাড়া সামনে ঈদ। কিন্তু এবার ঈদের কেনাকাটায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা পরিস্থিতি। দিনে মধ্যবিত্তের মার্কেটে ভিড় দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর শপিংমলগুলো ছিল প্রায় ক্রেতাশূন্য।
সরকারের সর্বাত্মক লকডাইনে মার্কেট চালু থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষেরই ছিল উদাসিনতা। বিক্রেতাদের তুলনায় ক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা বেশি দেখা গেছে।
মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনের নজরদারি প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ফটক দিয়ে ক্রেতারা যাতায়াত করছেন। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ।
মার্কেটের প্রবেশমুখে বসানো ডিসইনফেকটেড টানেলগুলোও অকেজো। অনেককেই যাতায়াত করছেন মাস্ক ছাড়া।
শুক্রবার হওয়ায় ক্রেতাদের সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তবে ঈদ সামনে রেখে যেসংখ্যক ক্রেতা আসার কথা, সেই তুলনায় তা কম।
বিক্রেতারা বলছেন, ঈদের কেনাকাটা তো দূর স্বাভাবিক সময়ের যেকোনো শুক্রবারের তুলনায়ও অনেক কম মানুষ এসেছে।
মার্কেটের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন আল আমিন গার্মেন্টসের কর্মচারী রায়হান বলেন, ‘আমাদের দিকে কাস্টমার অনেক কম।’
২ নম্বর গেট সংলগ্ন বর্ণিল সুজের ম্যানেজার কামরুল বলেন, ‘শুক্রবার হওয়ায় কাস্টমার বাড়ছে। তয় বিকিকিনি কম। সামনে হয়তো বাড়বে।’
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ক্রেতারা কম আসছেন বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
নয়ন নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘সরকার মার্কেট খুলছে কিন্তু মানুষ যে আসবে সেই রাস্তা বন্ধ করে রাখছে। বাস বন্ধ, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আসতে খরচ বেশি। যে কারণে দূরের ক্রেতারা আসতে পারছে না।’
এদিকে ক্রেতাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি অনীহাকে এলার্মিং বলছেন নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সিমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম শাহিন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মাইকিং করছি। ক্রেতাদের কাছে গিয়ে বলছি, তারা যেন কিছুটা দূরত্বে থেকে চলাচল ও কেনাকাটা করে, সবাই যেন মাস্ক পরে। আমাদের দোকানদারদের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানছে, কিন্তু ক্রেতারা আমাদের কথা শুনছে না। উল্টা ঝগড়া করছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বা প্রশাসনের লোকজন এই তদারকি করলে হয়তো লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মানত।’
গত দুই রমজানে নিজেদের বিক্রি নিয়ে হতাশার কথা বলেন রাজধানীর গুলশান-১-এর ডিএনসিসি মার্কেটের আদিতা শো রুমেরর কাপড় বিক্রেতা আব্দুল আহাদ। জানান, দোকানে তিনিসহ দুজন কর্মচারী। সন্ধ্যার পর ফাঁকা দোকানে বসে আছেন। গত তিন দিনে তিনজন ক্রেতা পেয়েছেন।
সকাল ১০ টায় দোকান খুলে বেলা দুইটায় বন্ধ করেছেন। তখন একজন ক্রেতা পেয়েছেন। এরপর সন্ধ্যায় আবার খোলেন। কিন্তু একজন ক্রেতাও আসেননি।
আক্ষেপ করে জানালেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিক্রি অনেক কম।
Captionডিএনসিসি মার্কেটের প্রায় পুরোটাই ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা শূন্য। বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীরা বিভিন্ন করিডরে নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছেন। আর দোকানের ভেতর একেকজন একেকভাবে খোশগল্প করছেন।
আব্দুল আহাদ বলেন, সরকার আবার সময় বেঁধে দিয়েছে আটটার মধ্যে দোকান বন্ধ করার। মার্কেটের কমিটি আটটা বাজলেই লাইট বন্ধ করে দেন।
রমজানের ঈদের আর সপ্তাহ দুই বাকি। এখনই ক্রেতারা নিজেদের কিংবা প্রিয়জনদের জন্য কেনাকাটা করবেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রেতারা ইফতারের আগে মার্কেটে আসেন। আর সাধারণত ইফতারের আগেই চলে যান। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন অবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘মার্কেট খোলা রেখে গণপরিবতন বন্ধ রাখলে ক্রেতা আসবে কীভাবে। আমাদের এখানে গুলশানের ক্রেতা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতা আসেন। তাদেরও আসার সুযোগ নেই।’
হোম টেক্সটাইলসহ গার্মেন্ট পণ্যের আরেক দোকান বিসমিল্লাহ স্টোর ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ক্রেতা না থাকলেও বিক্রি থাকে না। এখন মালিক যে বিনিয়োগ করেছেন, তা গত বছর থেকেই অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। দুজন কর্মচারীর বেতন এখন মালিক নিজে বহন করছেন। দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ উঠানোই দুষ্কর।’
তিনি বলেন, একে করোনার কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত; তারওপর মার্কেট খোলা রাখার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেয়া আছে। আর মানুষের মাঝে আতঙ্কও আছে। সব মিলিয়ে ক্রেতাদের মার্কেটে যাতায়ত খুবই সীমিত ‘
পণ্যের দাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ানো হয়নি। আগে যে দামে বিক্রি করেছি সেই দামই আছে।’
মার্কেটে বাচ্চাদের কাপড় দেখছিলেন আব্দুস সাত্তার। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, সব সময়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়েই মার্কেটে আসেন। কিন্তু গত দুই বছর করোনার কারণে তাদের নিয়ে আসা হয় না। তাই নিজেই পছন্দ করছেন।
ক্রেতা থাকলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতার দেখা পাওয়া যায়নি তেজগাঁও আড়ংয়ে দ্বিতল শো-রুমে। নির্দিষ্ট কিছু কর্নারেই ছিল ক্রেতাদের উপস্থিতি। এর মধ্যে তুলনামুলক বেশি ক্রেতা ছিলেন বয়স্ক ও বাচ্চাদের কর্নারে। এজন্য নিচের চেয়ে ওপরেই ক্রেতার সংখ্যা ছিল বেশি। নিচের কাউন্টারের সামনের লাইনেও ৪-৫ জন ক্রেতাকে বিল পরিশোধের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে বেশ ফাঁকা ছিল নিচের গহনার কাউন্টারের সামনে।
কেনাকাটা করতে আসেন একটি মানি এক্সচেঞ্চ হাউজের কর্মকর্তা আনোয়ার আহমেদ ভূঁইয়া বাপ্পি। তিনি বলেন, ‘এবার নিজের ব্যবসা খুব একটা ভালো নেই। তার ওপর করোনার যে অবস্থা, ঘর থেকে বের হতেই ভয় হয়। তাই কেনা কাটা করার ইচ্ছাও নেই এবার।
‘তিন বছরের মেয়ে তো সেটা বুঝে না। তাই তার জন্যই জামা কেনার জন্যই বের হওয়া। তাকে দাদির কাছে রেখে আমি ও আমার স্ত্রী এসেছি জামা কিনতে। সঙ্গে আমার মায়ের জন্যও এটা শাড়ি নেব।’
একাই আড়ংয়ে কেনাকাটা করতে আসেন রায়হান চৌধুরী। তিনি মেয়ে ও ছেলের জন্যই জামা কিনবেন। এজন্য প্রযুক্তির সহায়তাও নিচ্ছেন। মোবাইলে ভিডিওকলে ডিসপ্লেতে রাখা কাপড় দেখাচ্ছেন স্ত্রী ও মেয়েকে।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় সন্তানদের তো মার্কেটে আনা যায় না। যদিও তারা বায়না ধরেছিল নিজেরাই কিনবে। তবে ভিডিওকলের মাধ্যমে তাদের দেখিয়ে পছন্দ হলেই কেনা হবে এমন শর্তে তারা একা আসতে দিয়েছে।
Captionসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার সময় শপিংমলসহ দোকান খোলা থাকলেও বিক্রি খুবই কম। প্রতিটি দোকানের মাসিক খরচ আছে। তাদের কর্মচারীর বেতন ও দোকান ভাড়া দিতে হয়। আমরা চেয়েছিলাম এ সময়টিতে দোকান বা শপিংমল খোলা থাকলে এই খরচগুলো অন্তত উঠানো যাবে।’
তিনি বলেন, গত বছরের মতো এ বছরও করোনার থাবা আর শপিংমল বন্ধ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়ায় এখন ইফতারের পর খুব কমসংখ্যক ক্রেতা কেনাকাটায় বের হচ্ছেন।
ঈদের আর বেশি দেরি নেই। এই অবস্থায় শপিংমল খোলা রাখার সময় বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারকে কোনো প্রস্তাব দেবেন কি না জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে চিঠি দেব। যেন শপিংমল ৮টায় বন্ধ না করে আরও কিছু সময় খোলা রাখার অনুমতি দেয়া হয়।’
ব্যবসা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে আড়ংয়ের ব্যবস্থাপক ববি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার সময় ব্যবসা কেমন হয় তা তো আপনারা জানেনই। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।’
পরবর্তী সময়ে আড়ংয়ের ডেপুটি ম্যানেজার রেদুয়ান রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও একই বক্তব্য দেন। বলেন, ‘এ বছর আমাদের ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধরনের বক্তব্য দেয়ার অনুমতি নেই। তবে আপনার যদি বিশেষ কিছু জানার থাকে তাহলে ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।’