কোম্পানি পুনর্গঠনের খবরে যে উচ্ছ্বাস আর দাম বৃদ্ধির প্রবণতার মধ্যে ওটিসি মার্কেটে যারা প্রায় এক কোটি শেয়ার বিক্রি করতে পেরেছিলেন, তারা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন।
এক মাস ধরে ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আরও প্রায় এক কোটি শেয়ার বিক্রির অর্ডার থাকলেও এখন কেউ কিনতে রাজি হচ্ছেন না।
গত ৩ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ওটিসিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের প্রায় এক কোটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এই সময় লেনদেন হওয়া শেয়ারগুলোর গড় মূল্য ছিল ১ টাকা ৮৪ পায়সা।
তবে এখন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার বিক্রি করতে চাওয়া বিনিয়োগকারীরা দাম চাইছেন বেশি। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার সর্বোচ্চ তিন টাকাও দর চাওয়া হয়েছে।
তবে ১৪ মার্চ থেকে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির যেসব আদেশ দেয়া হয়েছে ওটিসি মার্কেটে তা এখনও বিক্রি হয়নি। এই সময়ে কোম্পানিটির ৯৯ লাখ ৩৭ হাজার ৫৬৯টি শেয়ার বিক্রির আদেশ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ টাকা দরে ৪ লাখ ৪ হাজার ২৫৩টি শেয়ার বিক্রির আদেশ দেয়া হয়েছে।
ওটিসিতে হঠাৎ নিভে গেল আগ্রহ
কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিনিয়োগাকরীদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়া, আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করাসহ নানা কারণে পুঁজিবাজারে মূল মার্কেট থেকে ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসিতে স্থানান্তর করা হয় গত ১৩ জানুয়ারি।
সে সময় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির ৭১ কোটি ৫৭ লাখ শেয়ার ছিল। কিন্তু কেউ কিনতে রাজি ছিল না শেয়ার।
এর মধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কোম্পানিটিকে ও নতুন করে চালুর সম্ভাবনা যাচাই করতে ৮ সদস্যের বোর্ড পুনর্গঠন করে। এই খবরে শুরু হয় তুমুল আগ্রহ।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কোনো শেয়ার বিক্রি না হলেও এই খবরে তিন দিনেই বিক্রি হয়ে যায় অর্ডারে থাকা সব শেয়ার।
সে সময় এই কোম্পানিটি ছাড়াও বিএসইসি কার্যক্রম বন্ধ থাকা আরও বেশ কিছু কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা জন্মায় কোম্পানিগুলো বুঝি শিগগির চালু হবে। তাই বেশি দামে হলেও শেয়ার কিনে নিতে আগ্রহ দেখায় বহুজন। ফলে টানা কয়েকদিন এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে একদিনে সর্বোচ্চ যত বাড়া সম্ভব ততই।
তবে ধীরে ধীরে বোর্ড পুনর্গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা জানান, এই উদ্যোগ মানেই কোম্পানি চালু হবে এমন নয়। নতুন বোর্ড কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা যাচাই বাছাই করবে। তারা কোম্পানি অবসায়নের প্রস্তাবও দিতে পারে।
আর স্বাধীন পরিচালক বসানোর এক মাসের বেশি সময়ে কোম্পানিটির কোনো অগ্রগতি না থাকায় মন্থর হয়ে এসেছে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ।
ওটিসিতে শেয়ার কিনলে বিক্রি করা সহজ নয়। তাই সেখানে নতুন করে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির মালিকপক্ষ প্রায় সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন পুঁজিবাজারে। কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের কথা থাকলেও তারা তা মানেনি।
বোর্ড পুনর্গঠনের খবরে হুলুস্থুল
মূল মার্কেট থেকে ওটিসি মার্কেটে স্থানান্তরের পর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের প্রায় ৭৮ লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। কিন্তু ক্রেতা ছিল না।
২৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের খবরে ভবিষ্যত বিবেচনা না করেই শেয়ার কিনতে থাকেন বহুজন।
পৌনে এক কোটি শেয়ার বিক্রির অর্ডার দুই-তিন দিনেই শেষ হয়ে যায়।
মূল বাজার থেকে ইউনাইটেডকে যেদিন ওটিসিতে পাঠানো হয়, সেদিন কোম্পানিটির দাম ছিল ১ টাকা ৯০ পয়সা।
সার্কিট ব্রেকার অনুযায়ী কোনো কোম্পানির শেয়ারদর এক দিনে ১০ শতাংশ বাড়তে বা কমতে পারে। কিন্তু এই বাড়া-কমার কিছুই ১০ পয়সার হিসাবের বাইরে হবে না।
ইউনাইটেডের শেয়াররদর এ কারণে সর্বোচ্চ ১০ পয়সা বাড়ানো বা কমার সুযোগ ছিল। আর সর্বোচ্চ পরিমাণে কমিয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সায় বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির অর্ডার আসে। কেউ কেউ অর্ডার দেন ১ টাকা ৯০ পয়সায়।
৩ মার্চ ৭৮ লাখ শেয়ারের সবগুলো বিক্রি হয়ে যায়। গড় দাম ছিল ১ টাকা ৮৪ পয়সা।
এরপর প্রায় ২ লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। হাতবদল হয় ২ টাকা থেকে ২ টাকা ১০ পয়সায়।
এরপর ১৮ লাখ শেয়ার বিক্রির অর্ডার আসে ১০ ও ১১ মার্চ। এই শেয়ারের বিক্রেতারা দাম চাইছেন ২ টাকা ৩০ পয়সা করে। এরমধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৩০০ শেয়ার ছাড়া বাকি সব শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়।
সময় দিতে হবে: বিএসইসি
কোম্পানিটির অগ্রগতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, কোম্পানিটি দুর্বল এবং লোকসানি। অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা থেকেই পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। বোর্ড কাজ করছে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি। তারাও চেষ্টা করছে। তবে এত দ্রুত কোম্পানিগুলোর সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে সেটা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।’
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পর্ষদ পুনর্গঠন হচ্ছে এই খবরে সবাই সেসব কোম্পানিগুলোর পেছনে ছুটেছে। কিন্ত বাস্তবে যারা সে সময় এসব কোম্পানির শেয়ার কিনেছে তারা এখন লোকসানে।’
তিনি বলেন, ‘এ জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত শুনেই বিনিয়োগ করা উচিত নয়। সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কী অবস্থা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেটি পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।’