রংপুরের আট উপজেলায় গত আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে সরাসরি ধান সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল ১০ হাজার ৩৮২ টন। এরমধ্যে সাত উপজেলা থেকে কোনো ধানই সংগ্রহ করতে পারেনি রংপুর খাদ্য বিভাগ। শুধু পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে মিলেছে দুই টন ধান।
ধান ছাড়াও ১৭ হাজার ৬৩৮ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে মিল মালিকরা হস্তান্তর করেছেন মাত্র ১ হাজার ৫৩৫ টন চাল।
চুক্তি ভঙ্গ করায় মিল মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুই-চার দিনের মধ্যে বৈঠক হতে পারে বলে জানিয়েছে রংপুর খাদ্য বিভাগ।
চলতি বোরো মৌসুমের ধানকাটা ও মাড়াইও শুরু হয়েছে। কয়েকদিন পরই বোরো মৌসুমে ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত আসবে। গত আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ায় বোরোর সময়ও সেই প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রংপুর খাদ্য অফিস থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ধান-চাল সংগ্রহের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জেলায় আমন মৌসুমে উপজেলাভিত্তিক ধান ও চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল রংপুর সদর উপজেলায় ১ হাজার ৭১ টন। বিপরীতে এক কেজি ধানও কিনতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। দুই হাজার ৯৬৬ টন চালের মধ্যে কেনা হয়েছে ২৬৭ টন।
বদরগঞ্জ উপজেলায় ধানের ১ হাজার ৬ টন লক্ষ্যমাত্রায় মেলেনি এক কেজিও। চাল কেনার কথা ছিল এক হাজার ৮৪ টন; কেনা হয়েছে ২০ টন।
মিঠাপুকুর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১৯৮ টন ধান; কিছুই মেলেনি। ৩ হাজার ৮৫৮ টন চালের বিপরীতে কেনা হয়েছে ৪১৯ টন।
পীরগঞ্জ উপজেলায় কেনার কথা ছিল এক হাজার ১৯৪ টন ধান; কেনা হয়েছে দুই টন। চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার ৮০২ টন; মিল মালিকরা দিয়েছেন ৬৭৯ টন।
তারাগঞ্জ উপজেলায় ধান ও চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫০২ টন ও দুই হাজার ৬৭৪ টন; এক কেজি ধান-চালও মেলেনি।
গঙ্গাচড়া উপজেলায়ও ৮৫০ টন ধান ও ৬৭৬ টন চাল কেনার কথা থাকলেও মেলেনি কিছুই।
কাউনিয়া উপজেলায় ৫৯৪ টন লক্ষ্যমাত্রায় কোনো ধানই কেনা যায়নি। আর এক হাজার ২৯৪ টন চলের মধ্যে পাওয়া গেছে চার হাজার ৬০০ টন।
পীরগাছা উপজেলায় ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬৭ টন; কেনা হয়নি এক কেজিও। অন্যদিকে চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ২৮৪ টন; এক ছটাক চালও কেনা সম্ভব হয়নি।
রংপুর খাদ্য বিভাগের দাবি, বাজারে ধান ও চালের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি হওয়ায় তারা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
জেলা খাদ্য বিভাগ জানায়, আমন মৌসুমে সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে দেয় প্রতি মণ ১০৪০ টাকা। সেই অনুযায়ী, এক মণ ধানে ২৬ কেজি চাল হিসাবে প্রতিকেজি চালের দাম পড়ে ৩৬ টাকা। তবে বাজারে চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৪০ টাকা। ফলে চুক্তি করেও মিলাররা চাল দেয়নি। সে কারণেই চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
তবে একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য এবং হয়রানির কারণে তারা গোডাউনে ধান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না।
রংপুর সদরের মমিনপুর এলাকার কৃষক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘গোডাউনোত ধান দেমো ক্যান? হামরা আদা-কাঁচা ধান সাড়ে ৯০০ টাকায় বেচাই। আর গোডাউনোত দিবের গেইলে ধান শুকান নাগবে। কামলা খরচ। ভ্যান খরচ আছে। ফির ওমারগুলের (কর্মকর্তা) হয়রানি। তারচেয়ে হামরা কাঁচাই বিক্রি করছি। সেটাই হামার লাভ।’
একই কথা বলেন ওই এলাকার মোশারফ হোসেন ও জাফর আলী নামে দুই কৃষক। তারা জানান, গোডাউনে ধান দিতে গেলে দালালদের আলাদা করে ধান বা টাকা দিতে হয়। খরচ না বাড়িয়ে তারা নিজেরাই হাটে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন।
রংপুর খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত বছর বোরো মৌসুমেও রংপুর জেলায় ধান-চাল ক্রয় অভিযান ব্যর্থ হয়। তবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় খাদ্য বিভাগের নিবন্ধিত অটোরাইস মিলসহ হাসকিং মিলার রয়েছেন ৮৮০ জন। তাদের মধ্যে ৮১ জন চুক্তি করলেও চাল দিয়েছেন মাত্র ৩০ মিলার।
নিয়ম অনুযায়ী, যেসব মিলের লাইসেন্স রয়েছে চাল সরবরাহ করতে সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি করতে হয়। চুক্তি করেও যদি কোনো মিল চাল না দেয় তবে জামানত বাজেয়াপ্তসহ চুক্তি বাতিল করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই নির্দেশনা গত দুই মৌসুম থেকে বাস্তবায়ন হয় না।
মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সামছুল আলম বাবু নিউজবাংলাকে জানান, সরকার আমনের মোটা চালের রেট দিয়েছে ৩৬ টাকা। অথচ বাজারে এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা। তাহলে কী করে তারা চাল দেবেন। এই কারণেই তারা চাল দেননি।
ধানের সঙ্গে চালের দাম নির্ধারণের বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা উচিত বলেও জানান তিনি।
রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খাদ্য কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য বা হয়রানির অজুহাত নয়, মূলত বাজারে ধান ও চালের দাম বেশি হওয়ায় নির্ধারিত দামে আমরা ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারিনি। আর যারা চুক্তি করেও চাল সরবরাহ করেননি তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’