বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জীবনধারণে কঠিন বাস্তবতা

  •    
  • ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০৯:১৭

আয় কমছে, চাকরি নেই, বাড়ছে পণ্যমূল্য। করোনাকালে চিকিৎসা আর বাড়তি যাতায়াত ব্যয় মেটাতে গিয়ে নাভিশ্বাস মানুষের। রাজধানী ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছেন বহুজন। কিন্তু এভাবে কত দিন?

রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন আব্দুল আলিম। মাসিক বেতন এবং প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে সব মিলিয়ে আয় ছিল ২০ হাজার টাকার মতো।

তবে এক বছরের বেশি সময় স্কুল বন্ধ থাকায় ঠিকমতো বেতন হচ্ছে না। এত দিন প্রাইভেট পড়ানোর ওপর নির্ভর করে কোনো রকমে বাসা ভাড়া দিয়ে টিকে থাকলেও এখন আর সেই সুযোগ নেই। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রাইভেট পড়ানোও বন্ধ। এখন ছাড়তে হবে প্রিয় এই শহর।

কঠিন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলিম বলেন, ‘ভাড়ার ৮ হাজার টাকা পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে দিয়েছি। আগামী মে মাসে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। সবকিছু স্বাভাবিক হলে হয়তো আবার ফিরে আসা হবে। তবে সেই আসা কবে তা জানি না।’

করোনার প্রথম ঢেউ শেষে অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক হওয়ার অবস্থায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখও ঘোষণা হয়েছে, সেই সময় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত।

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে- এই অবস্থায় ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় লকডাউন। ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় জরুরি সেবা ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান। যদিও বিশেষ বিবেচনায় খুলে দেয়া হয়েছে বিপণিবিতান।

তবে স্কুল-কলেজ খুলছে না সহসা, এটা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে। ফলে আব্দুল আলিমদের সহজে ঢাকায় ফেরা হচ্ছে না-এটা বলাই যায়।

দীর্ঘদিন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ছবি: নিউজবাংলা

তার মতো বহু মানুষের কাজ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে আয়ের পথ। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়ায় হিমশিম অবস্থা। নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশই এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।

নিম্ন আয়ের মধ্যে যারা গণপরিবহন খাতে কাজ করেন, তাদের আয় বন্ধ পুরোপুরি। পর্যটন খাতও বন্ধ। দেশের বড় দুটি পেশাজীবী গোষ্ঠীর তাদের আয়ের কোনো সুযোগই নেই।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার বা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহরে দরিদ্র্যদের সংকট সবচেয়ে বেশি। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, কিন্তু আয় নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। ফলে বড় সংখ্যাক মানুষের বেঁচে থাকাই এখন কষ্টদায়ক।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম বন্ধ করে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যাতে সহায়তা পায় সেই কর্মপন্থা দরকার।

রাজধানী ছেড়েছে মানুষ

মিরপুরের কাজীপাড়ায় বসবাস করতেন রোকন মাহমুদ। একটি কোচিং সেন্টার চাকরি, আর টিউশনি করে ভালোই চলত সংসার। গত বছরে করোনার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেলেও বছরের শেষ দিকে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। তখন আবার টিউশনি শুরু করেন তিনি। কিন্তু এখন তার কাজ পুরোটাই বন্ধ।

প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা প্রায় অসাধ্য হয়ে গেছে। তাই তিনিও পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ।

রোকন বলেন, ‘কখনো ভাবিনি এই ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। গ্রামে থাকলে প্রতি মাসে বাড়িভাড়ার টাকা নিয়ে অন্তত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। করোনা জীবনটারে একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে’।

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে শেওড়াপাড়ায় বসবাস করা উজ্জ্বল কুমার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি নির্দেশমতো বর্তমানে অফিস বন্ধ। কোম্পানি লোকসানে থাকায় ফেব্রুয়ারি মাসে দেয়া হয় অর্ধেক বেতন। মার্চেও কমিয়ে বেতন দেয়া হয়। কিন্তু এই টাকায় বাড়িভাড়া দেয়ার পর পরিবার নিয়ে চলা অসম্ভব। সামনে অবস্থা কী হবে জানি না। তাই গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে যায় অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে।

এবারও প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ না হলেও শহর ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম না সেটা বলাই যায়।

কাজের খোঁজে ভাসমান মানুষদের কী অবস্থা

কাজ চাই। ভোর থেকেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, অলিগলিতে দরিদ্র মানুষদের আনাগোনা। তাদের একটাই চাওয়া, কাজ। কিন্তু এই সংক্রমণে চাহিদামতো কাজ নেই।

রাজধানীতে ভাসমান শ্রমিক হাটগুলোতে ক্রমেই বাড়ছে নতুন মুখ। এদের কেউ কাজ করতেন পোশাকশিল্পে, কেউবা পরিবহনে। সবারই পরিচয় এখন দিনমজুর।

আর নতুন ‘প্রতিদ্বন্দ্বীদের’ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ, আগে থেকেই এই কাজে যুক্তদের। মহামারি নয়, জীবিকার সংকটেই আতঙ্কিত তারা। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিধস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে।

৭-৮ বছর মানুষের বাসায় বাসায় পত্রিকা বিলি করে জীবন নির্বাহ করেন আব্দুল্লাহ। করোনার কারণে অনেক বাসায় এখন পত্রিকা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সামান্য পত্রিকা বিলি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই তিনি বিকল্পি আয়ের খোঁজে।

একে তো কাজের অভাব, তারপরে আবার বাজারে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী। লকডাউনের মধ্যে কাজ জোটেনি, ঈদ পর্যন্ত টিকে থাকা নিয়েই সংশয়ে আছেন তিনি।

কঠোর নিয়ন্ত্রণের পর থেকেই প্রতিটি শ্রমিক হাটের অবস্থা বেশ শোচনীয়। দিনমজুরের উপস্থিতি থাকলেও কাজের দেখা নেই। সরকারি সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে, অনেকেরই নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু মেলেনি কিছুই।

বাড়ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি

পণ্য সরবরাহে বিঘ্নতা এবং বিশ্ববাজার থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নানান জটিলতায় বাড়তির দিকে মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ কম টাকায় মানুষ যে তার প্রয়োজন মেটাবে সেই সুযোগও নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার আভাস দিয়েছে। বলছে, করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

বিবিএসর হালনাগাদ তথ্য বলছে, গেল মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ।

লকডাউনের আগে রাজধানীর মাছের বাজারে চলছে বেচাকেনা। ছবিটি মোহাম্মদপুরের টাউন হল থেকে তোলা। ছবি: নিউজবাংলা

অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, চলতি বছরের মার্চে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৫ টাকা ৪৭ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি গেল কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধ্বগতি। জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এই সূচক। সামনে আরও বাড়ার শঙ্কা স্পষ্ট হচ্ছে।

মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ; জানুয়ারিতে যা ছিল ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

ভোজ্যতেল, চিনিসহ আরও কয়েকটি পণ্যের চড়া দামের কারণে মার্চ মাসে দেশের মানুষকে এই বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।

বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, পরিবহনে বাড়তি ব্যয় নতুন চাপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আলতাফ হোসেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এবার স্ত্রীও পজিটিভ। তাকে চিকিৎসা করাতে এ পর্যন্ত ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা চলে গেছে। এই যে অপ্রত্যাশিত ব্যয় সামাল দেয়া সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য কঠিন ব্যাপার।

এই সময়ে মেডিকেল পণ্যের দাম বেশ চড়া। অব্যাহতভাবে ওষুধের দাম, চিকিৎসকের ফি, ল্যাবরেটরি টেস্টের খরচ বেড়েছে। ফলে এক বছরে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে ৮১ শতাংশ।

ঢাকা মেডিক্যালে সিট খালি না থাকায় এক রোগীকে ভ্যানে করে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

রাজধানীতে বসবাসরতদের বরাবর প্রধান দুশ্চিন্তার নাম বাড়িভাড়া। করোনায় অনেকে ঢাকা থেকে চলে গেলেও বাসাভাড়া কমেনি। উল্টো বেড়ে গেছে।

পিপিআরসির জরিপ বলছে, এক বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

ইউটিলিটি বিলেও স্বস্তি নেই। বর্তমান কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে।

করোনাকালীন যাতায়াত খাতেও বেশি খরচ করতে হয়েছে। এক বছরে মানুষের যাতায়াত বাবদ ব্যয় ১০৪ শতাংশ বেড়েছে।

টিসিবির ট্রাকে মধ্যবিত্তরাও

রাজধানীতে শতাধিক ট্রাকে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। করোনার এই সময়ে সাশ্রয়ী মূল্যের এই সব পণ্য কিনতে নতুন মুখের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা কখনও এমন ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনেননি তারাও এখন দরিদ্র্যদের সঙ্গে এক কাতারে।

টিসিবির ডিলার রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক সময় স্বচ্ছল ছিলেন এমন অনেকেই পণ্য কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তেল, চিনি, ডাল নিচ্ছেন। অনেকে লাইনে না দাঁড়ালেও বাসার কাজের বুয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন পণ্যের জন্য।

‘অনেকেই অফিসের পিয়ন এবং কর্মচারীদের পাঠিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। একই ব্যক্তি প্রতিদিনই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। তারা মূলত অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের জন্য পণ্য নিয়ে দিচ্ছেন। লজ্জায় অনেকেই লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না।’

সহায়তা কম

করোনার প্রথম ধাক্কায় যে সহায়তা মিলেছে, দ্বিতীয় ধাক্কায় সরকারের বাইরে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে দরিদ্র মানুষদের বিপদ বেড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আড়াই হাজার টাকা করে দরিদ্র্য মানুষদের দেবার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু গেল বছর এই একই কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

নগরীর কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো উপহার ৪০০ চর্মকার ও নাপিতের হাতে তুলে দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ছবি: নিউজবাংলা

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষদের সহায়তায় কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কাজ হারানো বড় সংখ্যাক মানুষকে কত দ্রুত কাজে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই দিকটি সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে।

এ বিভাগের আরো খবর