করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে রাজস্ব আহরণে গতি ফিরে পায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ বাড়ায় রাজস্ব আয়ে ফের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। কারণ, করোনার বছর এমনিতেই ঘাটতি বেশি। উপরন্তু, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে চলমান কঠোর লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল হয়ে পড়ায় রাজস্ব ঘাটতি আরও বেশি হবে। ফলে সরকারের আর্থিক চাপ বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছিল, তাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ তথা রাজস্ব আদায়ে গতি ফিরে পায়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণে সবকিছু তছনছ করে দেয়ায় নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে রাজস্ব আদায় গতবারের চেয়ে খারাপ হবে।’
করোনার প্রাদুর্ভাবে গত অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি (আগের বছরের চেয়ে কম) আদায় হয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী আর কখনই এমন খারাপ অবস্থা দেখা যায়নি।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে মোট রাজস্ব আহরণ হয় ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
করোনাকালে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা রাখতে চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বিশাল ব্যয়ের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এই ব্যয় মেটাতে এনবিআরের মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে দেশে। অর্থনীতির অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ে মন্থর গতি দেখা দিয়েছে। ফাইল ছবি
তবে বিশাল ঘাটতির কারণে মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ কোটি টাকা।
রাজস্ব বোর্ডের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম আয় বা ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
আলোচ্য অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আয় হয় ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে মাত্র ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ, বাজেটে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয় ৩৫ শতাংশ।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুত বিস্তার ঘটায় এর প্রতিরোধে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন দেয় সরকার। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কিছুতেই ঠেকাতে পারছে না সরকার। যে কারণে ১৪ এপ্রিল এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনে দেয়া হয়। পরে তা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, গত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজস্বের অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। তবে এপ্রিলে লকডাউন থাকায় এর বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
কাস্টম হাউসগুলো খোলা থাকলেও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। আবার লকডাউনের কারণে এ মাসে এলসি খোলা বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
দোকানপাট, শপিং মল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ চাহিদায় প্রভাব পড়েছে। এই অবস্থায় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায় কম হচ্ছে। লকডাউনের কারণে মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমার সংখ্যা কমে গেছে।
মাঠপর্যায়ের ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেন, মোবাইল, সিগারেট ও ওষুধ ছাড়া বাকি সব খাতে ভ্যাট আদায় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে।
সাধারণত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল থাকলে আয়কর আদায় বাড়ে। লকডাউনে সরকারি উন্নয়ন কাজ থমকে গেছে। ফলে কর আহরণে ভাটা পড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ভ্রমণ করও আদায় হচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, এমনিতেই আমাদের রাজস্ব আয় খুবই কম। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস। ফলে রাজস্ব আয়ে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে কাঙ্ক্ষিত আদায় বাড়ানো যাবে না। আর রাজস্ব না বাড়লে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সরকার।