এমনিতেই প্রথম দফার করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার। গত এক বছরে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ৯ লাখেরও বেশি। করোনার প্রভাব কমায় কিছু প্রবাসী শ্রমিক কর্মস্থলে ফেরতও গেছেন। কিন্তু এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সাড়ে ৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার প্রথম ধাক্কাই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি প্রবাসী শ্রমবাজারের গন্তব্য দেশগুলো। এরই মাঝে আবার করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরের শুরুতে প্রবাসী শ্রমবাজার নিয়ে আশা জেগে উঠছিল। এখন তাতে আবার শঙ্কার মেঘ।
দেশে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হওয়ায় ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাইপলাইনে থাকা ৫ লাখ প্রবাসীর কর্মসংস্থানে ফেরা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, নতুন বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক শ্রমিক বাইরে গেছেন। নতুন আশা জাগছিল। কিন্তু এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের কারণে চিন্তায় পড়েছেন লাখ লাখ শ্রমিক।
এরই মাঝে অনেক দেশে করোনা বেড়ে গেছে। অনেক দেশে আগের পরিস্থিতি বিরাজমান। ফলে বৈদেশিক শ্রমবাজার খুললেও শঙ্কা কাটেনি। করোনা পরিস্থিতি না কেটে যাওয়া পর্যন্ত শ্রমবাজার আগের অবস্থায় ফেরার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটির) অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাফরিজা শ্যামা বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মী যাওয়া কিছুটা কমেছে। আসলে কর্মী যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আর শ্রমবাজারের সুখবর নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবাসী ডেস্কের দেয়া তথ্যমতে, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪ জন দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১৯ হাজার ১৭২ জন ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬ জন, ওমান থেকে ২৪ হাজার ৪৫৭ জন, কুয়েত থেকে ১৫ হাজার ২২৭ জন, বাহরাইন থেকে ৪ হাজার ৪৮৪ জন, কাতার থেকে ৪৯ হাজার ২৫২ জন, মালয়েশিয়া থেকে ১৭ হাজার ১০৬ জন, মালদ্বীপ থেকে ১৫ হাজার ৯৭৭ জন ও সিঙ্গাপুর থেকে ৮ হাজার ৪২৪ জন ফিরেছেন।
বিএমইটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৮৫ হাজার ২৪২ জন কর্মী।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৬৯ হাজার ৯৮৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫৯ হাজার ১৩৯ জন এবং মার্চে ৫২ হাজার ৯১ জন প্রবাসী শ্রমিক কর্মস্থলে গিয়েছিলেন। তিন মাসে মোট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন। এরপর চার মাসেরও বেশি সময় করোনার কারণে থমকে ছিল শ্রমবাজার। আগস্টে বৈদেশিক শ্রমবাজার আবার সচল হলে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কর্মী বিদেশে যান।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘যারা ফেরত এসেছেন, দেশে তাদের আয়ের পথগুলো কী হবে, তা নিশ্চিত করার সময় এসেছে। এ ছাড়া যারা বিদেশ যাচ্ছেন, তাদের যাওয়ার পদ্ধতি আরও নিরাপদ করার জন্য সরকারি উদ্যোগ থাকা দরকার।
বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, করোনার কারণে অভিবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট সবাই বিপদে আছেন। যেসব শ্রমিক দেশে এসে করোনার কারণে আটকে আছেন, তাদের দ্রুত কর্মস্থলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত।
এদিকে, ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরাতে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারে শনিবার থেকে শতাধিক বিশেষ ফ্লাইট অনুমোদন দেয় সরকার। এই পাঁচ দেশ হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুর।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানসহ মোট ১২টি দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস যাত্রী পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে। এগুলো হলো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস, ওমান এয়ার, সালাম এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, ইতিহাদ, এয়ার অ্যারাবিয়া, এয়ার অ্যারাবিয়া আবুধাবি ও ফ্লাই দুবাই।
এরই মধ্যে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে এই পাঁচ দেশের আট গন্তব্যে বিমান ও চার দেশের চার গন্তব্যে ফ্লাইট ঘোষণা করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস।
তবে প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেকে ফিরে এলেও করোনায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমাগত বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৮৬০ কোটি ৪৮ লাখ (১৮.৬০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (জুলাই-জুন) চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
প্রতিবছর দেশে যে রেমিট্যান্স আসে, তার প্রায় অর্ধেক পাঠান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা।