করোনা মহামারির সংকট মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন খাতে আরও কর ছাড়ের প্রস্তাব করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। একই সঙ্গে ব্যবসা সহজ করতে রাজস্ব বিভাগের পূণার্ঙ্গ অটোমেশনের সুপারিশ করা হয়েছে।
রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৪১তম পরামর্শক কমিটির সভায় এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে আগামী বাজেটকে সামনে রেখে এসব প্রস্তাব করেন সংগঠনের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ভাচুর্য়াল সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
সভায় এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন। অর্থমন্ত্রণালয় ও এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী চেম্বার ও সমিতির নেতারা এতে অংশ নেন।
আগামী অর্থবছরের জন্য ১৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে এফবিসিসিআই সভাপতি ফজলে ফাহিম বলেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যবসা বাণিজ্যে আরও চাপ পড়েছে। এ অবস্থায় টিকে থাকতে সহায়তা লাগবে। এ সময় ব্যাংকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করা উচিত হবে না। আর শুধু লকডাউন দিয়ে অর্থনীতি সচল হবে না।
তিনি আরও বলেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার কিছু অংশ মওকুফ করতে হবে। এক্ষেত্রে বড় ও রপ্তানিমুখী শিল্পে প্রণোদনা ঋণের পাঁচ শতাংশ, ক্ষুদ্র, কুটির ও এসএমই এবং কৃষি খাতে ঋণের ৫০ শতাংশ মওকুফ করতে হবে। ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ব্যাংকের বিজনেজ মডেল সংস্কার জরুরি। যেসব ব্যাংক প্রণোদনার অর্থ বিতরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে তাদেরকে এক শতাংশ প্রণোদনা দিতে হবে
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ব্যবসায়ীরা অর্থনীতির প্রাণ। আর ব্যবসা অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হচ্ছে। সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে সরকার কাজ করছে। যেসব সমস্যা আছে তা সংশোধন করে এগোতে চায় সরকার। করোনার কারণে কিছুটা হলেও লক্ষ্য থেকে সরে যেতে হয়েছে। এরপরও সরকার ব্যবসার উন্নয়নে কাজ করছে। ব্যবসায় সুযোগ সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে দেশের শক্তি বাড়ানো। অন্যদিকে, সরকারের নির্দিষ্ট পরিমান রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও রয়েছে। এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করেই আগামী বাজেট করা হবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আমরা ব্যবসা বান্ধব রাজস্ব প্রশাসন গঠন করতে চাই। এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। অডিট রিপোর্ট অনলাইনে জমার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই এ প্রক্রিয়ায় আসলে কর ফাঁকি কমবে।
এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবসমূহ
আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে আগামী দুই অর্থবছরের জন্য অগ্রিম কর বিলুপ্ত করা।
বর্তমানে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মোট লেনদেন তিন কোটি টাকার বেশি হলে লাভ লোকসান নির্বিশেষে শুন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে নূন্যতম আয়কর দিতে হয়।
এফবিসিসিআই মোট লেনদেনের পরিমাণ বাড়িয়ে পাঁচ কোটি টাকা এবং আয়ের ভিত্তিতে কর দেয়ার প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া করপোরেট কর হার আরও কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক বিভাগকে একটি সমন্বিত ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবনায় কৃষক থেকে পণ্য কেনার উৎস স্থলে করহার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ, পরিবেশবান্ধব রি-সাইক্লিন ও বর্জ ব্যবস্থাপনা খাতকে ভ্যাট ও টার্নওভার করের আওতা বহির্ভূত রাখা, ডিলার ব্যবসায়ীদের আয়ের ওপর ভিত্তি করে করহার নির্ধারণ এবং খুচরা ব্যবসায়ী, কনজ্যুমার গুডস ও কাপড়ের ব্যবসায় মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে ভ্যাট নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই।
ব্যবসায়ী নেতারা যা বলেন
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কৃত্রিম তন্তুতে ভ্যাট প্রত্যাহার ও ড্রেজার আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেন।
বেঙ্গল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. জসিমউদ্দিন খুচরা পার্টস আমদানিতে শুল্ক কমানো, রি-সাইক্লিন শিল্পে ভ্যাট প্রত্যাহার এবং সব রপ্তানি খাতের করপোরেট কর ১২ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।
উৎসে কর কমিয়ে অর্ধেক করা, করপোরেট কর আগামী পাঁচ বছর একই রাখা, নগদ সহায়তার ওপর আয়কর কমিয়ে তিন শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেন বিজিএমইএর নব নির্বাচিত সভাপতি ফারুক হাসান।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার, উৎসে কর কমানোর কথা বলেন।
সিমেন্টের কাঁচামালে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি আলমগীর কবির।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির আইটি খাতের রপ্তনিতে সহায়তার জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেন।
ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার ডিজিটাল লেনদেনে প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেন।
খুলনা চেম্বারের সভাপতি কাজী আমিনুল হক মহামারিকালীন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার প্রস্তাব করেন।
এ ছাড়া অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি টার্নওভার কর প্রত্যাহার ও সারচার্জ কমানোর প্রস্তাব করেন। বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ জনশক্তি রপ্তানি খাতে প্রণোদনা চান।