২০১২ সালের পর থেকে কখনও ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে না পারা খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ফাইন ফুড চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আছে লোকসানে। কিন্তু পড়তি বাজারেও মার্চে এই কোম্পানির শেয়ার দর হঠাৎ দেয় লাফ।
গত ২৮ ফেব্রুয়রি শেয়ারের দর ৫১ টাকা থাকলেও ১৬ মার্চ তা উঠে ৬২ টাকা ৭০ পয়সায়। পরে আবার কমতে কমতে তা নেমেছে ৪৭ টাকায়।
দাম যখন ৬২ টাকা, তখন দাম আরও বাড়বে ভেবে কেনেন রাফি চৌধুরী নামে একজন বিনিয়োগকারী। তবে এখন তিনি ভীষণ হতাশ। ফেসবুকে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক একটি গ্রুপে পোস্ট দিয়ে জানতে চেয়েছেন এখন কী করবেন।
দুর্বল কোম্পানির শেয়ার এত দামে কেনার কারণ জানতে মুহতাসিম রিজভী কটাক্ষকর জবাব দেয়ার পর পোস্টদাতা রাফি বলেন, চারমাস আগে কোম্পানির শেয়ারদর ১০০ টাকা ছিল।
কোম্পানিটি গত ৫ বছরে শেয়ার প্রতি সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে ২০১৬ সালে। সে বছর তাদের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ছিল ৮১ পয়সা। পরের চার বছরে তা হয়েছে যথাক্রমে ৬৫, ৭, ২৮ ও ১৮ পয়সা।
সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে ২০১৮ সালে, ৩ শতাংশ বোনাস। অর্থাৎ সে বছর ১০০টি শেয়ারে তিনটি বোনাস শেয়ার পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ১০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন তারা।
এই শেয়ারটি নিয়ে প্রায়ই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রচলিত কথায় ‘খেলা’ চলে।
বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই প্রলুব্ধ হন এর শেয়ার সংখ্যার ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে থাকার কারণে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে মালিকপক্ষকে। বিনিয়োগকারীরা ভাবেন, মালিকপক্ষ শেয়ার যখন কিনবে, তখন বুঝি দাম আরও বাড়বে।
শুধু ফাইন ফুড নয়, পুঁজিবাজারের সবচেয়ে দুর্বল কোম্পানি থেকে শুরু করে সবচেয়ে ভালো কোম্পানিটির ক্ষেত্রেও নানা গুজবে ঝুঁকে পড়েন বিনিয়োগকারীরা।
বলা হয়, এসব কোম্পানিতে ‘মামু’রা ঢুকেছে। শেয়ার দর বাড়বে হু হু করে। কিন্ত এই মামু কারা, তারা আসলে কোন কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন, সেটি কারও জানা থাকে না। কিন্তু লোভে পড়ে টাকা খুইয়ে পরে হতাশ হন বিনিয়োগকারীরা।
অবশ্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী এদেরকে ‘মামু’ না বলে ‘বড় বিনিয়োগকারী’ বলতে চান।
এই ‘বড় বিনিয়োগকারী’র কৌশলের কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা টাকা হারাচ্ছেন-এটি স্বীকার করে তিনি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবরে মামুদের খবরে পুঁজিবাজারে হঠাৎ দর বাড়তে থাকে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেডের। লোকসানি কোম্পানিটির শেয়ার দর ৪ টাকা ৮০ পয়সায় ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেডের শেয়ার দর এক মাসের কম সময়ে উঠে আসে ১০ টাকা ২০ পয়সায়।
শেয়ার প্রতি ৬ টাকা ২০ পয়সা লোকসানে থাকে এই ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও ‘মামু’ ঢুকেছে বলে সে সময় জোর গুজব ব্রোকারেজ হাউজ ও পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক ফেসবুক পেজগুলোতে।
তবে এক পর্যায়ে দাম কমতে থাকে। গত জানুয়ারিতে ১০ টাকা ৬০ পয়সা থেকে কমতে কমতে এখন ৬ টাকা ২০ পয়সায় নেমে এসেছে।
গত ২ বছরে এই শেয়ার নিয়ে ‘খেলা’ চলেছে মোট তিন বার। প্রতিবারই টাকা খুইয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
কারা এই মামু
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা সুনির্দিষ্ট করে এই সব মামুদের চেনেন না। কখনও দেখেন কি না তাও বলতে পারেনি। তবে শেয়ার কেনা ও মুনাফার খবরে একজন আরেকজনের কাছে এই মামুরা খুবই পরিচিত।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী মোজাম্মেল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে খুব কম বিনিয়োগকারী আছেন যারা নিজেদের সিদ্ধান্তে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য নিয়ে আবার কেউ অন্য কারও মাধ্যমে খবর নিয়ে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘ক্রামগতভাবে যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়তে থাকে তখন সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলে ধরে নেয়া হয় সেই কোম্পানিতে মামুরা প্রবেশ করেছেন। আবার অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা অপেক্ষায় থাকেন কখন মামুরা শেয়ার বিক্রয় করে বের হবে, সেই সময় বিক্রি করে বের হয়ে যান।’
বাংলাদেশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই নামগুলোর সঙ্গে পুঁজিবাজারের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী পরিচিত। তবে এটা একটি বায়বীয় বিষয়। এখন মামু কাকাদের নামে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল করার সুযোগ কম। সার্ভিলেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে সহজেই এখন পুঁজিবাজারে কারা কারসাজি করছে তা চিহ্নিত করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘স্যোশাল মিডিয়ায় কিছু মানুষ আছে যারা শেয়ার কেনা বেচা নিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়ে থাকে। তাদের ব্যাপারে সম্প্রতি বিএসইসি কঠোর হয়েছে। তবে এসব প্রচারণায় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির দিকই বেশি।’
জেনেছে বিএসইসিও
নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদেরকে প্রলুব্ধ করার এই বিষয়টির কথা জেনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব ও অপপ্রচার রোধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকা পেইজগুলোর সদস্যদের সর্তকও করে দেয়া আছে।
তবে বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের নেতা আতাউল্লাহ নাঈম মনে করেন, এ ক্ষেত্রে বিএসইসি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘মামুদের চেয়ে এখন বেশি সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজ ও গ্রুপগুলো। অনেক পেইজে মাসিক কমিশনের ভিত্তিতেও মুনাফা হবে এমন কোম্পানির শেয়ারের নাম দেয়া হয়। সেদিকেও নজর দেয়া উচিত।’
‘মামু’ না ‘বড় বিনিয়োগকারী’
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী গুরুত্ব দিয়েছেন বিনিয়োগ শিক্ষার ওপর। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যখন দেখে কোনো একটি কোম্পানির শেয়ার দর ক্রমাগত বাড়ছে তখন সেই কোম্পানির পেছনে ছুটতে থাকে। তার যখন শেয়ারে দর কমে আসে তখন বলা হয় এই শেয়ারের দর আরও কমবে।’
এই দুটিতেই ‘বড় বিনিয়োগকারী’র লাভ বলে মনে করেন তিনি।
প্রচলিত অর্থে যাদেরকে ‘মামু’ বলা হয় তারা এই ‘বড় বিনিয়োগকারী’ বলেই ধারণা শাকিল রিজভীর।
অপকৌশলটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বড় বিনিয়োগকারীরা কাউকে বলে শেয়ার কেনে না। তাদের যখন শেয়ার বিক্রি করার সময় আসে তখন গুজব ছড়ানো হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তখন শেয়ার কিনতে থাকে আর তারা বেশি দরে শেয়ার বিক্রি করতে থাকে।
‘একইভাবে শেয়ারের দর যখন কমে আসে তখন পুঁজিবাজারে বড় অংকের বিনিয়োগ আছে তারা কম দামে বেশি শেয়ার কিনে আর প্রচারণা চালায় এই শেয়ারের দর আরও কমবে।’
বিনিয়োগকারীদের সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে শাকিল রিজভী বলেন, ‘যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর বেশি বেড়ে যাবে তখন শেয়ার না কিনে অন্য কোম্পানির কম দামের শেয়ার কিনতে হবে।’