করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর সম্প্রতি ৬৬ কোম্পানির ক্ষেত্রে তা প্রত্যাহার। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলোচনা সমালোচনা তুঙ্গে।
- আরও পড়ুন: ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হলো
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ-ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান মনে করেন, পুঁজিবাজারে যে সমস্যাগুলো আছে, তাতে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা কোনো সমাধান না।
- আরও পড়ুন: ফ্লোর প্রত্যাহারে দাম কমল ঢালাও
তার দাবি, এই ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হচ্ছেন না। বরং কোনো কোম্পানির শেয়ার দর যত টাকা হওয়া উচিত না, ফ্লোর প্রাইসের কারণে সেটি তত টাকা হয়ে আছে। এতে সুবিধা নিচ্ছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
রকিবুর রহমান স্টক ব্রোকার থেকে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ (ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন) আলাদা হওয়ার আগে ডিএসই প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিসিবিএল) পরিচালক পদেও আছেন।
নিউজবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানালেন পুঁজিবাজারে কিসে মঙ্গল আর কোথায় সমস্যা।
বিএসইসি সম্প্রতি ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আপনি এটিকে কীভাবে দেখছেন?
প্রথম বলতে চাই ফ্লোর প্রাইস কেন দেয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে যেখন পুঁজিবজারে ক্রমাগত পতন হচ্ছিল তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি দিয়েছিলেন। করোনার সময় পুঁজিবাজারে পতন ঠেকাতে আমেরিকা, ভারত লাখ লাখ ডলার নিয়ে এসেছিল। আমাদের যেহেতু সে সক্ষমতা নেই তাই আমরা ফ্লোর প্রাইসে গিয়েছিলাম।
এখন কথা হচ্ছে, ফ্লোর প্রাইস দীর্ঘদিন থাকলে কার লাভ। জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারের লেনদেন হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল। ফেব্রুয়ারিতে আড়াই হাজার কোটি টাকাও লেনদেনও হয়েছিল। কিন্ত শতাধিক কোম্পানি তখনও ফ্লোর প্রাইসেই পড়ে ছিল।
কেন? কারণ এসব কোম্পানির ফান্ডমেন্টাল ভালো না। ভালো হলে নিশ্চয় দাম বাড়ত। বিনিয়োগকারীরা মনে করে ফ্লোর প্রাইস থাকলে সেই কোম্পানির তাদের জন্য নিরাপদ। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
বিশ্বের কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে এ ধরনের ফ্লোর প্রাইস নেই। আমরা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারের মানদণ্ডে ‘এ‘ ক্যাটাগরির। পুঁজিবাজারে বিশেষ কিছুর মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার দর আটকে রাখা হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমরা পিছিয়ে যাব। এটা হওয়া উচিত হবে না।
এখন আসেন ফ্লোর প্রাইসে লাভ কাদের। এটাতে তো কারো না কারো লাভ আছে। সেই লাভ হচ্ছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের। তারা জানে তাদের শেয়ারের এত দাম হওয়া উচিত না। কিন্ত ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেক বেশি দর দেখাচ্ছে। চাইলে তারা সেই দরে শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারছেন। এতে বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ নেই। ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিয়ে কোম্পানির শেয়ারের সঠিক দামে নিয়ে আসা উচিত।
কিন্তু পতনমুখী বাজারে ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার তো নতুন আতঙ্ক তৈরি করল।
পুঁজিবাজারের সূচক নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। সূচক কমলে পুঁজিবাজার খারাপ হচ্ছে সে ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বরং দেখতে হবে লেনদেন কেমন হচ্ছে। লেনদেন ভালো হওয়ার পর যদি সূচক শত পয়েন্টও কমে যায়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সূচক অনেক বাড়ালো আর লেনদেন হলো ২০০ কোটি টাকা, তাহলে সেটি আতঙ্কের।
বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর ফ্লোর প্রাইস পরিবর্তনের বিষয়ে বিএসইসি একটি নির্দেশনা দিয়েছে, কিন্ত ডিএসই সেটি পরিপালন করেনি। আপনি কি সেটি জানেন?
আমি এটি সম্পর্কে জানি না। পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষমতা ডিএসইর। আর এটার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিএসইসি। উভয়ের মধ্যে সমন্বিতভাবেই পুঁজিবাজার পরিচালিত হচ্ছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি এক নির্দেশনায় জানায়, কোনো কোম্পানি বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু করলে রেকর্ড ডেটের সর্বনিম্ম দরের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে সেই কোম্পানির নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ হবে। এমন নির্দেশনা পরও ডিএসই কোনো কোম্পানি বোনাস বা রাইট দেয়ার পর সমন্বিত দর যদি নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের কম হয় তাহলে পরিবর্তন করছে আর বেশি হলে আগের ফ্লোর প্রাইসই বহাল রাখছে, যা নির্দেশনার পরিপন্থী।
এ বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই। তবে বিএসইসির কোনো নির্দেশনাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আইসিবি বিলিয়ন ডলারের বন্ড ছাড়ছে। সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাংকের এতে বিনিয়োগ করবে শোনা যাচ্ছে। এতে পুঁজিবাজারের কী কী উন্নয়ন হবে।
আইসিবি যে বন্ডটি আনছে তা টাকায় প্রায় ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা হবে। এর মধ্যে আট হাজার কোটি টাকা আইসিবি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিল সেটি পরিশোধ করবে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংক থেকে আইসিবি যে ঋণ নিয়েছে সে টাকা তারা আবার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেনি। বিনিয়োগ করেছে নন-লিস্টেট কোম্পানিতে।
এখন ব্যাংক তাদের কাছে টাকা চাচ্ছে। সেই টাকা দিতে হলে আইসিবিকে তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে। এজন্য বন্ড থেকে যে টাকা আসবে তার থেকে আইসিবি আট হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করবে।
আইসিবি, সিডিবিএল কিন্ত পুঁজিবাজারে লেনদেন করার জন্য গঠন করা হয়নি। পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার জন্য করা হয়েছে। পুঁজিবাজারের ভালো মানের শেয়ারের দর যখন কমবে তখন তারা সেগুলো কিনবে। আর যখন বাড়বে তখন বিক্রি করবে। কিন্ত বিক্রি একবারে করবে না। অল্প করে বিক্রি করে, আবার কিনবে।
এছাড়া সে বন্ড থেকে যে টাকা আসবে তার একটি অংশ ব্যবহার করা হবে মার্জিন ঋণ প্রদানের জন্য। বতর্মানে মার্জিন ঋণের সুদের যে হার তার চেয়ে অর্ধেক সুদে তখন ঋণ দেয়া সম্ভব হবে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় পুঁজিবাজারের জন্য ভালো উদ্যোগ এই বন্ড।
অনেক সময় পুঁজিবাজারে প্রযুক্তিগত ক্রটির কারণে লেনদেনে বিঘ্ন হয়। কিন্ত প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজে আসছে না কেন?
এটা আমি স্বীকার করি যে, প্রায়শ ডিএসইতে কারিগরি ক্রটি দেখা দিচ্ছে। এর অনেকগুলো কারণ আছে। এটা নিয়ে বিএসইসি একটি কমিটি করেছে। সে কমিটিও এর জন্য অনেকগুলো কারণ পেয়েছে। আমরা সে সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে ডিজিটালাইজেশনের দিকে আমরা এগুচ্ছি। বিশ্বব্যাংকের এ জন্য সাত মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন আছে। আমাদের আর ছয় মাসের সময় প্রয়োজন। আশা করি এই সময়ের পর আর কোনো সমস্যা হবে না।
বিএসইসি মার্জিন ঋণের রেশিও বাড়িয়েছে। পুঁজিবাজারের লেনদেন বাড়াতে এটি কতটা যৌক্তিক?
পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হচ্ছে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা। এখন যে নিয়ম তাতে সাত হাজার সূচক পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে ৮০ টাকা ঋণ হিসাবে পাবে। আগে যা ছিল ৫০ টাকা।
বর্তমানে সূচক ৫ হাজার ২০০ পয়েন্টের আশেপাশে। গত জানুয়ারিতে সূচক সর্বোচ্চ ৬ হাজারের কাছাকাছি উঠেছিল। ফলে বিনিয়োগকারীরা চাইলেই মার্জিন ঋণের রেশিও অনুযায়ী ঋণ নেয়ার সুযোগ আছে।
কিন্ত আমি বলব, তারা যেন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের উদ্দেশ্য ছাড়া মার্জিন ঋণ না নেন। ডেইলি টেডিং করার জন্য মার্জিন ঋণ নিয়ে লোভে পড়া যাবে না।
আমি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেবে, তাদের কাছে যদি ২০ লাখ টাকা থাকে তাহলে সেখানে ১০ লাখ টাকা শেয়ার বাজারে নিয়ে আসুন। আর বাকি ১০ লাখ টাকায় স্থায়ী সঞ্চয়পত্র, বন্ডে বিনিয়োগ করুন। সব টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে নিজের পুঁজিকে ঝুকিতে ফেলবেন না। প্রয়োজনে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতিও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী নেই। এর কারণ কী?
ভারতের পুঁজিবাজারের দিকে তাকান। দেখবেন সেখানে সাধারণ কোম্পানিতে বিনিয়োগের তুলনায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী বেশি। আমাদের দেশে অনেকগুলো মিউচ্যুয়াল ফান্ড ভালো করছে। কিন্ত যেগুলো খারাপ করছে সেটিকেই বিনিয়োগকারীরা উদাহরণ হিসাবে নিয়ে আসে। এই জায়গাটিকে ঠিক করতে হবে।
আর আছে বন্ড মার্কেট। এখানে অনেকে বন্ড ছেড়ে টাকা সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। আমি বলতে চাই, যারা বন্ড ছাড়তে আগ্রহী তাদের কী কী সম্পদ আছে সেটি আগে যাচাই করতে হবে। তা না হলে নানাভাবে বন্ড মার্কেটও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাইব্যাক আইন নিয়ে অনেক দিনের আলোচনা। কিন্ত এটি এখনও অন্ধকারে। কেন?
বাইব্যাক আসলে কারা করবে? কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা করবে নাকি কোম্পানি করবে? আমাদের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। তারা মনে করে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা বাইব্যাক করবে। কিন্ত না। এটা করবে কোম্পানি।
কোম্পানির যখন মনে করবে তার শেয়ারের দর ৫০ টাকা হওয়া উচিত, কিন্ত পুঁজিবাজারে দর ২০ টাকা। তখনই কোম্পানি বাইব্যাক করবে। কোম্পানির যে রিজার্ভ আছে সেখান থেকে টাকা নিয়ে বাজার থেকে শেয়ার কিনবে। কিন্ত এই শেয়ার কেনার মাধ্যমে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর সুযোগ দেয়া যাবে না।