দেশে তাঁতে তৈরি পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বাংলা নববর্ষ বরণ বা পহেলা বৈশাখের আগে। এই মৌসুমকে ধরেই সারাদিন খটাস খটাস শব্দে চলে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ।
গত বছর বৈশাখের কিছুদিন আগেই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বন্ধ করে দেয় দোকানপাট, বাতিল হয়ে যায় নববর্ষ বরণের সব আয়োজন। ফলে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে ব্যবসায়ীরা।
এক বছর পর এসে সেই লোকসান কাটিয়ে এবার বৈশাখী পণ্য তৈরি করেছিলেন সিরাজগঞ্জের তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিধি বাম। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় এবারও সরকারের কঠোর বিধিনিষেধে মাথায় হাত তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীদের।
গত বছর ও এবার বর্ষবরণ উপলক্ষ্য করে বিশেষ ধরনের উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করতে সিরাজগঞ্জের সদর, বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়াসহ জেলার তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা।
কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈশাখী তাঁতবস্ত্র বিক্রি করতে না পারায় অনেক মালিক বাধ্য হয়ে বন্ধ করেছেন কারখানা। কারও গলার কাঁটা হয়েছে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা পরিবারসহ দিন কাটাচ্ছেন কষ্টে।
তাঁত মালিকরা বলছেন, তারা তিনটি উৎসব ঈদুল ফিতর, দুর্গাপুজা ও পহেলা বৈশাখকে টার্গেট করে কাপড় তৈরি করেন। সারা বছরের তৈরি কাপড় এই তিন উৎসবে শেষ হয়। কিন্তু করোনার কারণে গত বছরের তৈরি কাপড়ই বিক্রি করতে পারেননি। নতুন করে চলতি বছরের কাপড়ও সেখানে অবিক্রিত থাকবে। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়বেন তারা।
তাঁত মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশাখী উৎসবের জন্য শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ তৈরি করা হয়েছে। এগুলো শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার জন্যই তৈরি করা হয়। এসব পোশাক শুধু বৈশাখেই পরা হয় বলে বছরের অন্য সময় চাহিদা থাকে না।
তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা সংক্রমণ শুরু হলে তাঁতবস্ত্রের ব্যবসায় মন্দা ভাব শুরু হয়। উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। অনেকেই উৎপাদিত পণ্যে লোকসানে পুঁজি হারিয়েছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক তাঁতিদের অবস্থা খুব শোচনীয়।
এমন অবস্থায় অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তাঁত মালিকরা। কারখানা বন্ধ করে দিয়ে অনেকেই এখন গার্মেন্টসে, কেউ মাটিকাটা শ্রমিক, কেউবা রিকশা চালানোর কাজ করে জীবন চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের বেলকুচি অঞ্চলের লিঁয়াজো কর্মকর্তা তন্নী নিউজবাংলাকে জানান, জেলার এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, সদর ও উল্লাপাড়ায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জেলা তাঁত মালিক সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বিদ্যুতচালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা আড়াই লাখ ও অন্যান্য প্রায় ৫০ হাজার তাঁত রয়েছে। শিল্পটির সঙ্গে প্রায় ৪ লাখ পরিবারের ১৫ লাখ শিশু ও নারী পুরুষ জড়িত।
এ ছাড়া অন্য ব্যবসা ও পেশার লোকজন তাঁতশিল্পের উপর নির্ভরশীল। তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র
করে দেশের সর্ববৃহৎ এনায়েতপুর, বেলকুচির সোহাগপুর ও শাহজাদপুর কাপড়ের হাট গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে ও কাপড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনায়েতপুর ও সোহাগপুর হাটে প্রতি সপ্তাহের চারদিন (দিনরাত মিলে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে তাদের তৈরি পোশাক বিক্রি করেন। এখান থেকে ভারতে শাড়ি ও লুঙ্গি রপ্তানি হয়। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ দেড় শ কোটি টাকার লেনদেন হতো। যা এখন ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এতে খেলাপি ঋণের সংখ্যা বেড়েছে।
সিরাজগঞ্জ পাওয়ারলুম তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ এমএ বাকী নিউজবাংলাকে জানান, শুল্কমুক্ত হওয়ায় তিন বছর আগে ছয়টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনায়েতপুর, শাহজাদপুর ও বেলকুচির সোহাগপুর হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে চার লাখ পিচ শাড়ি ও লুঙ্গি ভারতে পাঠাতো। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কাপড় রপ্তানি হতো।
করোনার কারণে বিদেশে তাঁতবস্ত্র রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা দেয়া না হলে তাঁত শিল্পে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে।
ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড বেলকুচি শাখার ব্যাবস্থাপক মনির হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, করোনার পর থেকে ব্যাংকের লেনদেন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। উৎপাদিত কাপড় কমমূল্যে ও বাকিতে বিক্রি করায় অনেকেই লোকসান গুনছেন। তাই খেলাপি ঋণের সংখ্যা বাড়ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা তাঁত মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক হাজী বদিউজ্জামান বলেন, এ শিল্পের প্রতি সরকারের কোন সুনজর নেই। সারা দেশের প্রায় তিন কোটি লোক এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জেই ৫ লাখের বেশি তাঁত রয়েছে।
তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকে অব্যাহত লোকসানের কারণে প্রায় ৭০ ভাগ তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতমালিক, শ্রমিক ও কাপড় ব্যবসায়ীরা জেলায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রান্তিক তাঁতিরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সবাইকে পথে বসতে হবে।