করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকরের সময়টায় আট দিনের জন্য ব্যাংকের পাশাপাশি বন্ধ হচ্ছে পুঁজিবাজার। এর আগে সবশেষ লেনদেনে দেখা গেল সূচকের উত্থান। সবকিছু ঠিক থাকলে ২১ এপ্রিলের পর আবার শুরু হবে পুঁজিবাজারের লেনদেন।
বন্ধের আগের দিন মঙ্গলবার আস্থার পরিচয় দিল বিনিয়োগকারীরা। লেনদেনের শুরুতে সূচক পতনের ধাক্কা লাগলেও তা টিকেনি। বরং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সূচকসহ লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদর।
এর আগের বছর করোনা মহামারি বেড়ে যাওয়ায় এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল পুঁজিবাজারের লেনদেন। সে সময় পুঁজিবাজার বন্ধ হওয়ার কয়েক কার্যদিবস আগে লেনদেন নেমে এসেছিল ৪৯ কোটি টাকায়। এ ছাড়া ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ কোটি টাকায় ছিল লেনদেন। একইভাবে গত বছর পুঁজিবাজার বন্ধ হওয়ার আগের দিন সূচক বেড়েছিল মাত্র ৩২ পয়েন্ট। লেনদেন হয়েছিল ৩৪৮ কোটি টাকা।
কিন্ত এ বছর করোনা মহামারিতে পুঁজিবাজার বন্ধের আগের দিন সূচক বেড়েছে ৭০ পয়েন্ট। আর লেনদেন হয়েছে ৫১১ কোটি টাকা।
আস্থা কেন
পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ হচ্ছে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে সোমবার রাতে। যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, সরকারের ঘোষিত ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউনে বন্ধ থাকবে ব্যাংকের কার্যক্রম। খোলা থাকবে শুধু বন্দর এলাকার ব্যাংকের শাখা।
বিএসইসির পক্ষ থেকে রাতে জানানো হয়, যেহেতু ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে সেহেতু পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ থাকবে। এমন সিদ্ধান্তের পর প্রথম লেনদেন হয় মঙ্গলবার।
যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে টাকা উত্তোলন করতে চান তারা মঙ্গলবার শেয়ার বিক্রি করলেও সে টাকা পাওয়া যাবে পুঁজিবাজার খোলার পর। কারণ, শেয়ার বিক্রির এক দিন পর টাকা উত্তলনযোগ্য হয়। আর তারও দুই থেকে তিন কার্যদিবস পর পাওয়া যায় ব্যাংক হিসাবে।
বুধবার থেকেই পুঁজিবাজার ও ব্যাংক বন্ধ। এমন অবস্থায় মূলত যারা শেয়ার কিনতে আগ্রহী ছিলেন তারা শেয়ার কিনেছেন। বাকিরা পর্যবেক্ষণ করেছেন পুঁজিবাজার।
সাত দিন পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় এ সময়ে শেয়ার কেনার কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যারা শেয়ার কিনতে চাচ্ছিলেন, তারা মঙ্গলবার শেয়ার কিনেছেন। আর যাদের শেয়ারে মুনাফা আছে, তারা শেয়ার বিক্রি করেছেন।
এমনটা আগেই বলেছিলেন ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিদুল ইসলাম। সোমবার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, সাত দিনের জন্য পুঁজিবাজার বন্ধ হওয়ায় মঙ্গলবার লেনদেনের পরিমাণ বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাত দিনে যারা শেয়ার কিনতেন তারা মঙ্গলবার কিনবেন। আর যাদের লাভ হয়েছে বলে শেয়ার বিক্রি করতে চাচ্ছিলেন তারা মঙ্গলবার শেয়ার বিক্রি করবেন। ফলে সার্বিকভাবে মঙ্গলবার লেনদেন বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
পরবর্তী সময়ে শাহিদুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থার কারণে মঙ্গলবার সূচক বেড়েছে। সঙ্গে লেনদেনও। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করেননি। প্রথম পর্যায়ের লকডাউনের পর যখন পুঁজিবাজার খোলা হয় তখন ভালো অবস্থায় গিয়েছিল। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তখন আগ্রহ নিয়ে নতুন বিনিয়োগ করেছিলেন। এবারও তা হতে পারে, সে ধারণা থেকেই শেয়ার বিক্রির চেয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ বা কেনার প্রতি আগ্রহী ছিল বিনিয়োগকারীদের।
আগ্রহী ধরে রেখেছে বিমা ও ব্যাংক
মঙ্গলবার লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ছিল বিমা খাতে। তালিকাভুক্ত ৫০টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৯টির। দর কমেছে ৭টির। দর পাল্টায়নি ২টির। ফ্লোর প্রাইস ছিল ২টি কোম্পানি।
লেনদেন দিনের সর্বোচ্চ দর বেড়েছে মাত্র তিনটি কোম্পানির, যা বিমা খাতের। ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ ছাড়া দর বৃদ্ধির তালিকায় ছিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স।
দর বেড়েছে ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানেওর। ব্যাংক খাতের ৩১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ২২টির। দর কমেছে ৪টির। বাকি ৫টির দর পাল্টায়নি।
নন ব্যাংক আর্থিক খাতে তালিকাভুক্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ১৬টির। কমেছে ২টির। দর পাল্টায়নি ২টির। আর ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে ৩টি প্রতিষ্ঠান।
বিশ্লেষকের বক্তব্য
ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, সাত দিনের জন্য পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা যে এতে আতঙ্কিত হয়নি সেটির প্রমাণ পাওয়া গেল।
তিনি বলেন, গত বছরেও আমরা দেখেছি লকডাউন পরবর্তী যখন লেনদেন শুরু হয়েছে তখন সূচকসহ ভালো অবস্থায় ছিল পুঁজিবাজার। লেনদেন হাজার কোটি টাকা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এটা আস্বস্তের বিষয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হয়ে অপেক্ষা করা উচিত।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। গত বছরে প্রথমবার লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার পরবর্তী লেনদেনে ভালো মুনাফা পেয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
তিনি বলেন, সে প্রত্যাশায় শেয়ার বিক্রি থেকে বিরত ছিল বিনিয়োগকারীরা। হঠাৎ করে বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে না দিলে বাজার হয়তো আরও ভালো থাকতো। সে কোম্পানিগুলোর ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলোর দর কমে আসায় প্রথম দিকে সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
সূচক ও লেনদেন
মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুতে সূচক কিছুটা নেতিবাচক হলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্থানে ফিরে আসে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে কেনার আগ্রহের কারণে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭০ দশমিক ২২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে। শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৫ দশমিক ৬০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৯৮ পয়েন্টে। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৩৬ দশমিক ৮২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৯৭ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২২৮টির, কমেছে ৬৩টির; পাল্টায়নি ৫৬টির। এ সময়ে মোট লেনদেন হয়েছে ৫১১ কোটি টাকার। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৪৯৪ কোটি টাকা। ফলে আগের দিনের তুলনায় ডিএসইতে লেনদেন বেড়েছে ১৭ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৮৫ দশমিক ৬১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৯৪ পয়েন্টে। লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচুওয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১২৪টির, কমেছে ৬২টির। দর পাল্টায়নি ২৮টির। মোট লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।