দেশে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি যে কয়েকটি খাত প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিল, তার মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল এভিয়েশন খাত। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত বন্ধ ছিল আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সব ফ্লাইট। জুলাই থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে সীমিত পরিসরে ফ্লাইট শুরু হলেও যাত্রী ছিল নিতান্ত কম।
করোনার মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র চার মাসে ১ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা আয় বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আয়বঞ্চিত হয় ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার। অর্থাৎ সক্ষমতা থাকার পরও করোনার কারণে ৮ মাসে ৩ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা আয় করতে পারেনি বিমান।
পরে এয়ারলাইন্সগুলোর দাবির মুখে তাদের সব ধরনের অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফ করে সরকার। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি।
অবশ্য অক্টোবরের পর অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা স্বাভাবিক হয়ে আসে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ দেশি বাজারের ৮০ ভাগেরও বেশি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
এ বছরও মার্চে করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ শুরু হলে ৫ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে সংকটে পড়েছে দেশি এয়ারলাইন্সগুলো। এর মধ্যে ১৪ এপ্রিল থেকে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও বন্ধের ঘোষণা দিলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
এমনিতেই বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ রুটগুলোর ওপর নির্ভর করে টিকে ছিল দেশি এয়ারলাইন্সগুলো। চলমান লকডাউনের কারণে এখন গভীর অনিশ্চয়তায় তারা।
বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন এভিয়েশন অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, চলমান এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে কঠিন সংকটে পড়তে যাচ্ছে এ খাত।
সংগঠনের উপদেষ্টা এ টি এম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডমেস্টিকে সরকার এখন যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, এটা আমি মনে করি সব দিক বিবেচনায় ঠিকই আছে। কিন্তু এতেও যদি কাজ না হয়, এ অবস্থা যদি কন্টিনিউ হয়, তাহলে চরম বিপর্যয় হতে পারে।
‘এমনিতেই এয়ারলাইন্সগুলো যখন গত মার্চে বন্ধ হলো, জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এ সময় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিন্তু কাটিয়ে ওঠা যায়নি। যদিও পরে তারা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। বিশেষ করে গত বছরের শেষে তারা কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের চেয়েও ভালো একটি অবস্থানে ছিল।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ৩ মাসের গ্যাপটা কাভার করতে পারেনি। এখন যদি আবার লম্বা সময়ের জন্য সব বন্ধ করা হয়, তাহলে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। মহাবিপদ হবে।
‘যদি পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হয়, তাহলে সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্য বিধি মেনে ফ্লাইট খুলে দেয়া যায় কিনা তা সরকার ভেবে দেখতে পারে।’
অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, মানুষের জীবনকেই এখন সবকিছুর চেয়ে এগিয়ে রাখছে সরকার।
সংস্থার চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন তো আসলে ব্যবসা আমরা দেখছি না। আমরা দেখছি মানবতা। জীবন আগে। আমাদের দেশকে বাঁচাতে হবে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। সরকার যে ব্যবস্থাপনাগুলো নিয়েছে, এগুলো মানুষের জন্যই।
‘এখন ইন্ডাস্ট্রি এগুলো পরে আসবে। যে হারে করোনা বেড়েছে, মানুষকে হাসপাতালে সিট দেয়া যাচ্ছে না। এখন এটাকে দমন করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। তারপরে ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান – এগুলো সব পরে হিসাব হবে।’
দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে গত ৩ এপ্রিল থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় বেবিচক। এটি ছাড়াও বিশ্বের আরও ১২টি দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলো ছাড়া বাংলাদেশে ফ্লাইট বন্ধ আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও উরুগুয়ের।
অবশ্য এ দেশগুলোর মধ্যে শুধু কাতার ও তুরস্কের সঙ্গেই সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে দেশি এয়ারলাইন্সগুলোর। বাকি দেশগুলো সাধারণত তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশে যাত্রী পরিবহন করে। এ কারণে আন্তর্জাতিক রুটে খুব একটা সংকটে পড়তে হয়নি দেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে।
বেবিচকের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪ এপ্রিল থেকে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকবে এক সপ্তাহের জন্য। অবশ্য কার্গো ও বিশেষ ফ্লাইট চলবে স্বাভাবিকভাবেই। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হলে সংকট আরো বাড়বে।