সাত দিনের লকডাউন শুরুর আগে যে চিত্র, কঠোর লকডাউন শুরুর আগেও সেই একই পরিস্থিতি। ব্যাংক-পুঁজিবাজার চালু থাকবে-নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমন ইঙ্গিত দিলেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসায় কম দামে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। লকডাউন আতঙ্কের পাশাপাশি ৬৬টি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম তুলে দেয়াও এর এক কারণ।
গত সোমবার থেকে চলা লকডাউনের প্রথম তিন দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিএসইর প্রধান সূচকে প্রায় ২৫০ পয়েন্ট যোগ হয়েছিল সত্য। তবে তার আগের দিন ১৮১ পয়েন্ট সূচক কমে আতঙ্কে।’
এবার কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার পর প্রথম কার্যদিবসে ডিএসই সূচক হারাল ৯০ পয়েন্ট। দর বেড়েছে যেখানে মাত্র ২৪টি কোম্পানির, সেখানে দর হারিয়েছে ২৬৪টি। যে ৫২টি কোম্পানি দর ধরে রেখেছে, সেগুলোর দর এর চেয়ে কমা সম্ভব নয় বলেই তা ধরে রাখা গেছে।
এই পরিস্থিতিকে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের ‘মহামারি’ বলতে শুরু করেছেন।
আগামী বুধবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসার পর আগের সেই আতঙ্ক আবার ভর করেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম ও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম যা বলেছেন, তাতে এই ইঙ্গিত মেলে যে বর্তমানে যেভাবে লেনদেন চলছে, সেভাবেই চলবে কঠোর লকডাউনেও।
তবে কেন্ত্রীয় ব্যাংক বা বিএসইসি এখনও আনুষ্ঠানিক আদেশ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। আর বিষয়টি আনুষ্ঠানিক হওয়ার আগে আস্থার সংকটের বিষয়টি স্পষ্ট।
আতঙ্কে ‘ঘি’ ঢেলেছে খোদ বিএসইসি। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দিয়ে যে আদেশ এসেছিল তার মধ্যে ৬৬টির সর্বনিম্ন সীমা তুলে দেয়া হয় বৃহস্পতিবার। সেদিন ব্যাপক দরপতনের পর শনিবার দরপতন ঠেকাতে নেয়া হয় নতুন সিদ্ধান্ত। বিএসইসি জানায়, এসব শেয়ারের দর ১০ শতাংশ বাড়তে পারবে এক দিনে। তবে কমতে পারবে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ।
রোববার এসব কোম্পানির বেশিরভাগই দর হারিয়েছে এই দুই শতাংশ।
এই ৬৬ কোম্পানির শেয়ারধারীদের আতঙ্ক ভর করেছে বাকিগুলোর শেয়ারধারীদের ওপরও। তাদের মনে শঙ্কা জেগেছে বাকিগুলোর সর্বনিম্ন দরও হয়ত প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এতে শেয়ার দর ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তাই নতুন বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না বিনিয়োগকারীরা। শেয়ার ধরে রাখতেও ভয় পাচ্ছেন তারা।
বিনিয়োগকারীরা যে হাত গুটিয়ে বসে, সেটির প্রমাণ লেনদেনেই। জানুয়ারিতে যে বাজারে দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, সেখানে লেনদেন এখন সাড়ে চারশ কোটি টাকার আশেপাশে।
বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষক বক্তব্য
লেনদেন শেষে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘লকডাউনের প্রথম তিনদিন খুবই ভালো ছিল। তখন অনেক কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছিল। চতুর্থ দিন দর সমন্বয় হবে এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়ার কারণেই সূচকের পতন হয়েছে এটা বলা ঠিক হবে না। ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলেই যে ঢালাও ভাবে শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে সেটাও ভালো চিন্তা না।’
তবে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল গত বছর করোনা মহামারিতে যেনে পুঁজিবাজারের ক্ষতি না হয়। আবার সেটিকে পরিবর্তন করে দেয়া হলো করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে। লকডাউনের মধ্যে পুঁজিবাজার ভালো চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলে দিয়েছে।
‘ফ্লোর প্রাইস যেখন লেনদেন হচ্ছিল তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক ছিল না। ধারণা ছিল, এর নিচে না নামবে না, ফলে লোকসান হবে না। কিন্তু যখন ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হলো তখনই আতঙ্ক শুরু হলো। আর লোকসান হতে থাকল। তাই এ সময়ে ফ্লোর প্রাইসে ফিরে যাওয়াই ভালো হবে।’
সেই ৬৬ কোম্পানির শেয়ারদরের কী অবস্থা
সর্বনিম্ন দাম প্রত্যাহার করে নেয়া ৬৬ কোম্পানির মধ্যে ইয়াকিন পলিমার, এমএল ডাইং, আইএফআইসি ইসলামী মিউচ্যুয়াল ফন্ডের দর কমেছে ২ শতাংশ করে।
খুলনা পাওয়ার লিমিটেড, এএফসি অ্যাগ্রো, ইউনিক হোটেল, সাফকো স্পিনিং মিলস, প্রাইম টেক্সটাইল স্পিনিং মিলসের শেয়ার দর কমেছে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ করে।
কাট্টালি টেক্সটাইল, মিথুন নিটিং, প্যাসিফিক ডেনিম, ইন্টোকো, সায়হাম কটন, সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স, ফার্স্ট ফিন্যান্স, সায়হাম টেক্সটাইল, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, অলেম্পিক এক্সসোসরিজ, রিং সাইন, জাহিন স্পিনিংসহ প্রায় সবকটি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে ২ শতাংশের কাছাকাছি।
সূচক ও লেনদেন
লেনদেন শুরুর ৫ মিনিটে সূচকের পতন হয় ৩৬ পয়েন্ট। আর ১৫ মিনিটে পতন হয় ৭০ পয়েন্টের বেশি।
তবে লেনদেনের শেষ সময়ে সূচকের পতন আরও বেড়ে ডিএইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৯০ দশমিক ০৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৬৪ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২০ দশমিক ০৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৭ পয়েন্টে। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক কমেছে ৩৭ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট।
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৪টির, কমেছে ২৬৪টির। দর পাল্টায়নি ৫২টির। মোট লেনদেন হয়েছে ৪৫৬ কোটি টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন ছিল ৪৭৫ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক ডিএএসপিআই ২৪৭ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৩ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৬টির, কমেছে ১৩৯টির। দর পাল্টায়নি ২৭টির। লেনদেন হয়েছে মোট ১৪ কোটি টাকা।