করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিকনিদের্শনা রাখার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম এই সংগঠনটি বলেছে, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ হচ্ছে- আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর, আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং জ্বালানি, যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাত। বেসরকারিখাতের প্রত্যাশা হচ্ছে আসছে বাজেটে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
শনিবার ডিসিসিআই আয়োজিত ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা : অর্থবছর ২০২১-২২’ শীর্ষক ওয়েবিনারে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান প্রধান অতিথি এবং ব্র্যাক-এর চেয়ারপার্সন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। ডিসিসিআইর আয়োজনে যৌথ সহযোগিতা দেয় দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল ২৪।
প্রাক বাজেট আলোচনায় ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থা, শিল্পায়নের বিকাশ এবং উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে যেতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে কার্যকর পদক্ষেপ থাকবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। যে বাজেটে বেসরকারিখাতের প্রত্যাশাই গুরুত্ব পাবে।’
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এর সুফল সব জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু শুল্ক বা করের হার গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে না থাকলে, তা ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত করবে। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত না করে কী হারে রাজস্ব বাড়ানো যায় তার একটি দিকনির্দেশনা সরকার বাজেটে নিশ্চয় রাখবে। দেশে কর ব্যবস্থা টেকসই ও সহনশীল হওয়া চাই। সেটা ৭-১০ বছরের জন্য হলে ভাল হয়। তাহলে দেশে বিনিয়োগ সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানো প্রয়োজন। তবে তা সম্ভব হচ্ছে না বিভিন্ন খাতকে বিভিন্ন হারের কর অব্যাহিত দেয়ার কারণে। ফলে জিডিপিতে করের অবদান কমছে। কিন্তু সবাইকে মনে রাখতে হবে করের হার নির্ধারণ ও সরকারের ব্যয়ের বিষয়ে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।
‘সেই সঙ্গে নাগরিকদের ওপর আরোপিত ট্যাক্স সেই নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য কিনা সে বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন পর্যায়ে মূসক আদায়ের ফলে অনেক ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে এর হার বেড়ে যায়। তবে ঘন ঘন করের হার বাড়ানো-কমানো ঠিক নয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাজেট শুধুমাত্র কর আহরণের বিষয় নয়, এটি সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটি রূপরেখা। বর্তমানে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছি। বাজেটে এ ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং পরিস্থিতি উত্তরণের একটি সুনিদিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। সেই সাথে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে।’
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এসএমই খাতেও গুরুত্ব থাকার বিকল্প নেই। এ খাতের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতে মাইক্রো ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউট (এমএফআই) গুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রণোদনা প্যাকেজ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছানো যায়, সে লক্ষ্যেও একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি জরুরি।
‘দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতেও একটি যুগান্তকারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাত নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই জরুরি। এর পাশাপাশি তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স এর পর আমাদের প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলো কী হবে, সেগুলোকেও চিহ্নিত করার পরামর্শ রাখেন তিনি।’
ওয়েবিনারে চারটি খাতের ওপর আলোচনায় সরকারি ও বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
‘আর্থিক খাত’ সেশনের আলোচনায় আইপিডিসি এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেট উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর চাপ কমানো সম্ভব হবে। অন্যান্যের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ-এর সিইও নাসের এজাজ বিজয়, নগদ-এর সিইও রাহেল আহমেদ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম অংশগ্রহণ করেন।
‘শিল্প ও বাণিজ্য’ সেশনের আলোচনায় বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইনাম আহমেদ, বিকেএমইএ-এর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক, বেঙ্গল গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ড. মো. মাসুদুর রহমান অংশগ্রহণ করেন।
‘ট্যাক্সেশন ও ভ্যাট’ সেশনের আলোচনায় কেপিএমজি-এর সিনিয়র পার্টনার আদিব হোসেন খান, এফসিএ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস পলিসি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া, সদস্য (ভ্যাট নীতি) মো. মাসুদ সাদিক এবং সদস্য (কর নীতি) মো. আলমগীর হোসেন অংশগ্রহণ করেন।
‘অবকাঠামো (জ্বলানি, লজিস্টিক ও স্বাস্থ্য)’ সেশনের আলোচনায় ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফাইজুর রহমান, প্রাইভেট ই জেড অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ-এর সভাপতি এ এস এম মাইনুদ্দিন মোনেম এবং বুয়েট-এর পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম অংশগ্রহণ করেন।
মো. ফাইজুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েকবছর আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত অগ্রগতি হচ্ছে। তবে এ খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অগ্রাধিকার জরুরি। প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেও দরকার কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।’
এ এস এম মাইনুদ্দিন মোনেম বলেন, ‘অবকাঠামো খাতের চলমান প্রকল্পসমূহের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির আরও উন্নয়ন হবে। ইপিজেড এলাকায় বিদ্যুৎ, জ্বলানি, গ্যাস সংযোগ ও রাস্তাঘাট তৈরির কাজ সময় মতো শেষ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, ভবিষ্যতে আমাদের কী ধরনের জ্বালানি প্রয়োজন, সেটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করে সে মাফিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বস্তবায়ন খুবই জরুরি।