ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের নীতিমালা জারির পর একটি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস সেভাবেই সংশোধন হলেও দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা লঙ্ঘনের অভিযোগ করছেন বিনিয়োগকারীরা।
শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের নীতিমালা ভঙ্গের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ- ডিএসইকে কিছু বলেনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
নীতিমালা অনুযায়ী রেকর্ড ডেটের দামের সঙ্গে বোনাস শেয়ারের সমন্বয় করে নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের কথা। কিন্তু শাহজালাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে বোনাসের পাশাপাশি সমন্বয় হয়েছে ক্যাশ ডিভিডেন্ড, আর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয়ই হয়নি।
এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও বাস্তবে কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির।
সম্প্রতি দুটি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস সংশোধন নিয়ে জটিলতা দেখা যায়, লোকসানে পড়েন সেসব কোম্পানির শেয়ারধারীরা।
নিয়ম অনুযায়ী, ফ্লোর প্রাইসের নিচে লেনদেন হবে না কোম্পানির শেয়ার। এমনকি প্রতিটি কোম্পানির যে সার্কিট ব্রেকার দেয়া থাকে, কোনো কোম্পানি যদি ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়ে থাকে তাহলে সে কোম্পানির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসের কারণে সর্বোচ্চ দরে বাড়তে পারবে, কিন্তু কমতে পারবে না।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যখন বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু করে তখন সেই কোম্পানির শেয়ার দর সমন্বয় হয়ে থাকে।
পুঁজিবাজারে লেনদেন করছেন এক বিনিয়োগকারী। ফাইল ছবি
সমন্বয় করা দর নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের কম হলে পরিবর্তন করা হয় সেই কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস। এটি সংশোধন না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাভবান হবেন বিনিয়োগকারীরা। আবার সমন্বয় দর ফ্লোর প্রাইসের বেশি হলে আগের ফ্লোর প্রাইসই বহাল থাকে। এতে লোকসান হয় বিনিয়োগকারীদের।
এভাবেই নির্ধারিত হয়ে আসছিল কোম্পানির সংশোধিত ফ্লোর প্রাইস।
এমন অবস্থায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনো কোম্পানি বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু করলে রেকর্ড ডেটের আগের সর্বনিম্ন দরের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে পরিবর্তন হবে সেই কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস।
বিএসইসির এমন নির্দেশনা দেয়ার দুই মাসেও তা কার্যকর হয়নি। বরং ডিএসই বলছে, তারা আগের নিয়মে ফ্লোর প্রাইস পরিবর্তন করছে। বিএসইসি যে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে, সেটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
ফলে বিএসইসির নতুন নিয়মে ফ্লোর প্রাইস বিবেচনা করে যারা শেয়ার কিনছেন তারা হিসাব মেলাতে পারছেন না। এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন বিনিয়োগকারীরা।
লভ্যাংশের বিপরীতে নতুন ফ্লোর প্রাইস
১৫ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি ৭৬১তম সভায় ফ্লোর প্রাইস সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ঘোষিত বোনাস বা রাইট শেয়ারের রেকর্ড ডেটের পরবর্তী সর্বনিম্ন দরকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সংশোধিত ফ্লোর প্রাইস হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
এ হিসেবেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেডের (বিএটিবিসি) সংশোধিত ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় ৫১৮ টাকা। বিএটিবিসি তার শেয়ারধারীদের জন্য নগদের পাশাপাশি ২০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। রেকর্ড ডেটের আগে কোম্পানিটির সর্বশেষ দর ছিল ১ হাজার ৫৫৪ টাকা। বিএসইসির নির্দেশনার পর এটাই ছিল প্রথম ফ্লোর প্রাইস সংশোধন।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অন্য কোম্পানিগুলো, যারা বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করবে তাদের ক্ষেত্রে এভাবেই ফ্লোর প্রাইস সংশোধন করা হবে বলে জানানো হয়।
কিন্তু শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ব্যাংকটির রেকর্ড ডেটের আগের সর্বনিম্ন দর ছিল ২২ টাকা। যেমনটি ছিল বিএটিবিসির ক্ষেত্রে, ১ হাজার ৫৫৪ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটি ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করায় ব্যাংকটির ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ হওয়ার কথা ১৯ টাকা ৯০ পয়সা।
কিন্তু ব্যাংকটির ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ টাকা ২০ পয়সা।
এ ছাড়া মার্কেন্টাইলের ক্ষেত্রে ঘটেছে আরও বিস্ময়কর ঘটনা। ফ্লোর প্রাইস পুনর্নির্ধারণই করেনি ডিএসই। বিএসইসির ঘোষণা অনুযায়ী, কোম্পানির নতুন ফ্লোর প্রাইস হওয়ার কথা ছিল ১২ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু সেটির কোনো পরিবর্তন না করায় এখনও ১০ টাকা ৬০ পয়সাতেই অপরিবর্তিত আছে।
বিএসইসি ও ডিএসই বক্তব্য
১৫ ফেব্রুয়ারি ফ্লোর প্রাইস নীতিমালা ঘোষণার পরও ডিএসই তা পরিবর্তন না করে পুরোনো নীতিমালায় ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমনটি হওয়ার কথা না। নীতিমালা অনুযায়ী তা পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু ডিএসইও ভুল করার বিষয় না। কেন এমন হলো সেটি দেখে জানাতে হবে।’
ডিএসইর উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান আগের মতোই বুধবারও বলেন, ‘দুটি হিসাবই সঠিক। তবে ডিএসইর আগের নিয়মে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের অনুমতি আছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নীতিমালা জারি করা হলে পূর্বের নিয়ম অনুসরণ করার কথা নয়। কারণ, আগের নিয়ম বাতিল করেই নতুন নীতিমালা জারি করা হয়েছে।’
তিনি জানান, পুঁজিবাজারের সিংহভাগ বিনিয়োগকারী এখন বিএসইসি থেকে যে নীতিমালা জারি করা হয় সেগুলোর যাচাইবাছাই করে বিনিয়োগ করে থাকেন। এখন নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ফ্লোর প্রাইস আর আগের নিয়মের ফ্লোর প্রাইস এক হবে না।
ফ্লোর প্রাইস যেহেতু কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন দর হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেহেতু এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নীতিমালা অনুযায়ীই ডিএসইর তা নির্ধারণ করা উচিত।
বিনিয়োগকারী ও সংগঠনের বক্তব্য
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছে মূলত সেই কোম্পানির শেয়ার দর স্থিতিশীল রাখার জন্য। এখন যদি আবার সেটি পরিবর্তন হয় তাহলে যে উদ্দেশ্যে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল সেটির কার্যকারিতা থাকে না।’
নীতিমালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএসইসি যেহেতু একটা নীতিমালা দিয়েছে সেহেতু সে অনুযায়ীই হওয়া উচিত। ডিএসইর আগের নিয়ম থাকলেও সেটি বিবেচনা করার সুযোগ নেই।’
বিনিয়োগকারী আজমল হোসেন বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস বিবেচনা করে অনেক বিনিয়োগকারী সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকেন। বোনাস ও রাইটের পর সেই কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস কত হবে সেটি বিএসইসির নীতিমালা অনুযায়ীই হিসাব করে পরবর্তীতে আবার বিনিয়োগ হবে। কিন্তু সেই হিসাব যদি ডিএসইর কারণে গড়মিল হয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এজন্য নীতিমালা অনুযায়ী ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।