লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়া হলে রেকর্ড ডেটের দামের সঙ্গে বোনাস শেয়ার সমন্বয় করে নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করার কথা থাকলেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা মানেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ, ডিএসই।
রেকর্ড ডেটের আগের দিন ১৩ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন বন্ধ হওয়ার কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কোম্পানিটির নতুন ফ্লোর প্রাইস হওয়ার কথা ছিল ১২ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু ডিএসই নতুন ফ্লোর প্রাইস ঠিক করেনি।
রেকর্ড ডেটের পর মঙ্গলবার শেয়ারটি নতুন যে ফ্লোর প্রাইস হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে এক টাকা কমে লেনদেন শেষ করেছে।
৯৮৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ৬২ দশমিক ২৯ শতাংশ শেয়ার এখন সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে। এদের হাতে শেয়ার সংখ্যা ৬১ কোটি ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭০১টি। প্রতিটি শেয়ারে এক টাকা করে সম পরিমাণ টাকা লোকসান হয়েছে তাদের।
এই এক টাকার পুরোটা অবশ্য লোকসান নয়। এক টাকা শেয়ারধারীরা লভ্যাংশ হিসেবে পেয়ে যাবেন। তবে যাদের ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন আছে, তাদের কাছ থেকে ১০ পয়সা করে আর যাদের এই নম্বর নেই, তাদের কাছ থেকে ১৫ পয়সা করে ট্যাক্স কাটবে সরকার।
তবে এই ট্যাক্স ছাড়া পুরো টাকাইটা মুনাফা হওয়ার কথা ছিল বিনিয়োগকারীদের।
- আরও পডুন: বোনাস-রাইট শেয়ারে কমবে ফ্লোর প্রাইস
২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণের পর পুঁজিবাজারে ধস নামে। সে সময় শেয়ারের মূল্যপতন ঠেকাতে প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেয় বিএসইসি, যা পরিচিতি পায় ফ্লোর প্রাইস নামে।
এতদিন লভ্যাংশ ঘোষণার পরও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না হলেও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি একটি শেয়ারের বিপরীতে দুটি বোনাস শেয়ার দেয়ার পর বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক নির্দেশনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, বোনাস ও রাইট ইস্যুর পর রেকর্ড ডেটে যে দর থাকবে, তার সঙ্গে বোনাস ও রাইট শেয়ারের সমন্বয় করে নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ হবে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি রেকর্ড ডেটে দামের সঙ্গে বোনাস ও রাইট শেয়ারের সমন্বয় করে ফ্লোর প্রাইস পুনর্নির্ধারণের নির্দেশ দেয়
বিএটিবিসির ফ্লোর প্রাইস নেই নির্দেশনা অনুযায়ীই পুনর্নির্ধারণ হয়। আগের ফ্লোর প্রাইস ৯০৬ টাকা ৭০ পয়সা ছিল। কিন্তু রেকর্ড ডেটে কোম্পানিটির দাম ছিল এক হাজার ৫৫৪ টাকা। ২০০ শতাংশ বোনাস ধরে নতুন ফ্লোর প্রাইস ছিন হয় ৫১৮ টাকা।
কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৩০ টাকা করে চূড়ান্ত নগদ লভ্যাংশও ঘোষণা করেছিল। ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেটিও বিবেচনায় আনা হয়নি।
- আরও পড়ুন: বিএটিসিবির ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় যেভাবে
কিন্তু দুই ব্যাংক শাহজালাল ও মার্কেন্টাইলের ক্ষেত্রে ডিএসইর উল্টো নীতি শেয়ারধারীদের ক্ষতির কারণ হয়েছে।
শাহজালালের দাম রেকর্ড ডেটের আগে ছিল ২২ টাকা। ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার ধরলে নতুন ফ্লোর প্রাইস হওয়ার কথা ১৯ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু শেয়ার প্রতি ৭০ পয়সা নগদ ধরে ফ্লোর প্রাইস ঠিক হয়েছে ১৯ টাকা ২০ পয়সা।
পরদিনই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা আরও বিস্মিত হয়ে যান। এই কোম্পানির নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণই করেনি ডিএসই। আগের মতোই ১০ টাকা ৬০ পয়সা রয়েছে তা।
- আরও পড়ুন: বিএটিবিসির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস কত হবে
ব্যাংকটির রেকর্ড ডেটের আগের সর্বশেষ দর ছিল ১৩ টাকা ৩০ পয়সা। এ হিসাবে ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করায় মঙ্গলবার ব্যাংকিটির সংশোধিত ফ্লোর প্রাইস হওয়ার কথা ১২ টাকা ৭০ পয়সা। এই দামেই শেয়ারটির দাম সমন্বয় হয়েছিল।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য শেয়ারপ্রতি এক টাকা করে নগদ ও ৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ২০টি শেয়ারে একটি করে বোনাস শেয়ার দেয়ার প্রস্তাব করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।
ডিএসই নিজেই বিভ্রান্ত
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) উপ মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান প্রথমে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণে তাদের নির্ধারীত পদ্ধতি সঠিক বলে জানান।
কিন্ত বিএসইসি পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে, নির্দেশনাটি পাঠাতে বলেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ফ্লোর প্রাইস পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে বিএসইসির নির্দেশনাটি জানেনই না
পরে তিনি দবি করেন, দুটি পদ্ধতিই সঠিক। বিএসইসির পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হলেও ভুল হবে না। তবে ডিএসইকে বিএসইসির নতুন নির্দেশনার বাইরে আগের নিয়মে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের আদেশ দেয়া আছে।
বিনিয়োগকারীরা ক্ষুদ্ধ
বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ১২ টাকা ৭০ পয়সার নিচে দাম নামবে না ভেবে রেকর্ড ডেটের আগের দিন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মার্কের্টাইলের শেয়ার কিরেছিলেন সাইফুল ইসলাম। কিন্তু রেকর্ড ডেট শেষে শেয়ারের দামে তিনি হতবাক হয়ে যান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা কেমন কথা হলো। ডিএসইর দায়িত্বে যারা আছেন, তারা আসলে কী করেছেন? বিএসইসি এখানে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? পুঁজিবাজার নিয়ে এমনিতে আস্থার সংকট। এভাবে যদি কেবল উদাসিনতা আর খামখেয়ালির কারণে শেয়ারধারীদের ক্ষতি হয়, তাহলে এই সংকট কীভাবে কাটবে?’
আরিফুল ইসলাম নতুন বিনিয়োগকারী। সদ্য বিও হিসাব খুলেছেন। তিনিও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের পর হিসাব করে মার্কেন্টাইলের শেয়ার কিনে হতাশ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা তো রীতিমতো তামাশা করল। বিএটিবিসির ক্ষেত্রে যা হলো, এখানে তার উল্টোটা কেন?’
জানেই না বিএসইসি!
ডিএসই যে এই কাজ করেছে, সেটি জানাই নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির। শাহজালাল ও মার্কেন্টাইল কাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকে কয়েকটি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস পাল্টেছে। মার্কেন্টাইলেরটি হওয়ার কথা।’
তাহলে কেন পরিবর্তন হয়নি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যাচাই করে দেখছি।’
ডিএসইসর উপ মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান যে দাবি করেছেন, ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের নতুন লিখিত নির্দেশনার বাইরেও মৌখিক অন্য নির্দেশনা আছে- এটা কতটা সত্য?- এমন প্রশ্নও ছিল রেজাউল করিমের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘এমনটা তো জানা নেই। কাগজ দেখে বলতে হবে।’