এক বছরের মাথায় দেশ আবার ঢুকে পড়ল লকডাউনের বলয়ে। শুরুতে এক সপ্তাহের হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই মনে করছেন, এটি দীর্ঘায়িত হবে।
করোনার প্রথম অভিঘাতের পর সরকারঘোষিত বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ চাপ সামলে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছিল। দ্বিতীয় অভিঘাতে কী হবে, এখনও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব যে গভীর হবে, এ আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। কেননা, সবকিছু বন্ধ থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরবরাহব্যবস্থা। গণপরিবহনের অভাবে পণ্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা-নেয়া করা যাবে না। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ‘বাড়তি’ প্রণোদনা দেয়া ও জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, একদিকে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পারা, অন্যদিকে দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারা সরকারের কৃতিত্ব। তাদের মতে, ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সোপানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, প্রাণঘাতী করোনার ধাক্কায় তখন সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। তবে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এই অর্জন প্রশংসীয় বলে মনে করেন বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা এ অগ্রগতিকে প্রশংসা করেন।
করোনার টিকা দেয়া শুরু হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়ায় অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। ফলে করোনাকালে চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করছে সরকার। যদিও বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা এর সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে।
অর্থনীতিতে ক্ষতির আশঙ্কা
কারোনার কারণে গত এক বছের দেশে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ হয় নি। উদ্যোক্তারা আশায় বুক বেঁধে আছেন, পরিস্থিতি ভালো হলে নতুন করে বিনিয়োগ করবেন।
কিন্ত করোনা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগ স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সামনে রোজা এবং ঈদ। তারও আগে বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ। আমাদের দেশে দুই ঈদে অর্থনীতিতে ভালো লেননেদেন হয়। এতে করে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।
পরিসংখানে বলে, দুই ঈদে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চার থেকে পাঁচ শতাংশ। করোনায় ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বৈশাখী ভাতা চালুর পর থেকে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ধারণা করা হয়, পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হয়, তা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ।
এবার লকডাউন এলো এমন সময়, যখন পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা শুরু হচ্ছে। ফলে এবারের লকডাউনের কারণে পয়লা বৈশাখ ও ঈদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যাতে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
যোগাযোগ করা হলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নিবার্হী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, লকডাউনে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে। খেটে খাওয়া মানুষদের কষ্ট বাড়বে। ফলে এদের জন্য নগদ সহায়তা দিতে হবে।
সংকেটর মধ্যেও আশার আলো
সময়টা কঠিন হলেও সামনের দিনগুলোতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এরই মধ্যে অবকাঠামো খাতে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার) ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের সবচেয় বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বড় ধরনের প্রণোদনা ঘোষণায় মার্কিন জনগণের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়বে। ফলে সে দেশে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদাও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সামস মাহমুদ বলেন, ‘এটা সত্যি, লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে বাংলাদেশ।’
এর কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, আমেরিকায় দ্বিতীয় প্রণোদনা ঘোষণায় সে দেশের ভোগ ব্যয় বেড়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। আমেরিকায় ভোগ বাড়লে আমাদের দেশের পোশাক পণ্যের চাহিদা বাড়বে। এদিকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। ফলে সেখানে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা আছে। আবার মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ফলে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি আদেশ চলে যাচ্ছে। এ সুযোগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ কিছু আদেশ পেতে পারে।
সামস মাহমুদ মনে করেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে। তবে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান ধরে রাখবে অর্থাৎ কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করবে না, প্রণোদনা দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে তাদের। তা না হলে উদ্যোক্তাদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হবে বলে জানান তিনি।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পোশাকের কাঁচামাল সুতার দাম বেড়েছ, সংকট চলছে। এ অবস্থায় আমরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি।’
‘পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভয়াবহ’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, লকডাউনের ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ব্যহত হয় উৎপাদন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পোশাক খাতের ঋণের কিস্তি একই সঙ্গে সুদ মওকুফের দাবি জানান তিনি।