বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বেসিক ব্যাংকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস

  •    
  • ৩ এপ্রিল, ২০২১ ১০:০৭

লোকসানের কারণে ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বেসিক ব্যাংক। সংকটাপন্ন ব্যাংকটিকে উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ কাজে লাগেনি।

‘বেতন কি কখনও কমে?’- রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বেসিক ব্যাংকের কর্মীদের বেতন কমিয়ে দেয়ার পর আক্ষেপের সুরে এমন মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছেন এক কর্মকর্তা। বলেছেন, ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে লাভে আনা যায় তার নানাবিধ পন্থা আছে, তাই বলে কি বেতন কমিয়ে তা করতে হবে?’

দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়া এই ব্যাংকটিকে বাঁচাতে কর্মীদের বেতন কমানোকে শেষ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করেছে সরকার। নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করার ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। সংকুচিত হয়েছে বাড়ি ভাড়া ও গ্রাচ্যুইটি সুবিধাও। যাদের গৃহঋণ নেয়া আছে, তারা বেকায়দায় পড়েছেন।

বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৯ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড স্বতন্ত্র বেতন স্কেল পেয়ে আসা একটি ব্যাংক। এর এতদিনের বেতন কাঠামো রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি।

বেতন কর্তনের সিদ্ধান্তের পর দুই হাজার কর্মীর বুকে এখন দীর্ঘশ্বাস।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ‘ব্যাংকের সবাইতো দুর্নীতিগ্রস্ত না। অথচ সবাকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে। বেতন কমিয়ে দেয়ার ফলে ব্যাংকটি উন্নতির চেয়ে কর্মীদের মনোবল ভেঙে গেছে।’

তাদের প্রশ্ন: মুনাফা না হওয়ার কারণে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে, এমন নজির নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংককে এখন দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বিতরণ থেকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ বেশি বিতরণ করতে হবে। তবে ঋণ দেয়ার আগে কোন প্রকল্পে কাকে দেয়া হচ্ছে, সে বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজ করতে হবে।‘ব্যাংকের জনবল আরও কমিয়ে আনতে হবে। কম জনবল দিয়ে কীভাবে ভালো কাজ করা যায় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে মূলধন ঘাটতি বাবদ অর্থ বা বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দের আবেদন করতে পারে।

বেসিক ব্যাংকের এমডি আনিসুর রহমান

‘একসময় এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প উদ্যোক্তা) খাতে বেসিক ব্যাংকের অনেক অবদান ছিল। এ জন্য ক্ষুদ্র ঋণের কিছু অর্থ এ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে বেসিকের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করতে হবে।‘বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক সময় বিভিন্ন ব্যাংককে সিআরআর (নগদ জমার হার) বা এসএলআর (সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতিসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়। বেসিক ব্যাংককেও এ ধরনের সুবিধা দিতে পারে।’ব্যাংক খাত কাঁপানো অনিয়ম২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে অনিয়মের মাধ্যমে মোট সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানসহ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের প্রমাণ মেলে।বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে প্রমাণ মেলে।

এরপর থেকে সবল ব্যাংকটি দুর্বল হতে থাকে। সে দুর্বলতা এখনও ব্যাংকটি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দুর্বলতা কাটাতে বেসিক ব্যাংককে সরকার থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। তাতেও দুর্বলতা কাটেনি।তিন বছর ধরে ব্যাংকটিকে কোনো মূলধনের জোগান দেয়া হচ্ছে না। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোনো মূলধন পাবে না বেসিক ব্যাংক। নিজস্ব উদ্যোগে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু টিকে থাকতে নানামুখী পরিকল্পনা করেও উন্নতি নেই।

অবস্থার পরিবর্তন নেই

পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন নেই, একই চক্করে থমকে আছে বেসিক ব্যাংক। অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি আদায় কিছুটা বাড়লেও ব্যতিক্রম শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এই ব্যাংক। নানামুখী কৌশল হাতে নিয়েও পাল্টাচ্ছে না পরিস্থিতি।

ব্যাংকটির মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি। অনিয়মের মাধ্যমে এ ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

খাদের কিনার থেকে টেনে তুলে ব্যাংকটিকে মূলধন যোগান দেয় সরকার। পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনসহ গ্রহণ করা হয় নানা কৌশল। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও কমছে না খেলাপির পরিমাণ।

বাড়ছে খেলাপি ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঋণস্থিতি ১৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণেও ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও ১ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফলে সংকটে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে বেসিক ব্যাংক।

ক্রমান্বয়ে বাড়ছে লোকসান

বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে। পরবর্তী সময়ে তা কমে ২০১২ সালে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।

এরপর থেকে ধারাবাহিকভাব লোকসানে পড়তে থাকে ব্যাংকটি। ২০১৩ সালে ৫৩ কোটি টাকা লোকসান করে। ২০১৪ সালে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির লোকসান বেড়ে হয় ৩১৮ কোটি টাকা।

অতীতের অনিয়ম জালিয়াতির চূড়ান্ত ধাক্কা লাগে ২০১৬ সালের নিট মুনাফায়। ওই বছর ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকায়।

এরপর ২০১৭ সালে ৬৮৪ কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালেও ৩৫৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি।

২০১৯ সালে ৩২৭ কোটি টাকা নিট লোকসান গোনার পর ২০২০ সালেও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বেসিক ব্যাংকের।

কমেছে বেতন

লোকসানের কারণে ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্যাংকের ৪৮৭তম পর্ষদ সভায় বেসিক ব্যাংকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত হয়।

২২ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ওইদিন থেকেই এটা কার্যকর বলে জানায় বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়: ‘সাত বছর ধরে ব্যাংকের ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা ব্যাংকের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ জন্য ব্যাংকের বর্তমান বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা বাতিল করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের “চাকরি (ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ ২০১৫”-এর অনুরূপ বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হলো। তবে ব্যাংকের বেতন কাঠামোর বাইরে অন্যান্য সুবিধা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে দেয়া হবে।’

ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মীরা বেতনের বাইরে লাঞ্চ-ভাতা, গাড়ির ঋণ, অতিরিক্ত বোনাস ইত্যাদি সুবিধা পেয়ে থাকেন।

২০১৪ সালে ব্যাংকটি বিশেষায়িত থেকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে।

বেসিক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের মূল বেতন স্কেল দেড় লাখ টাকা। অন্যদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকে একই পদের মূল বেতন স্কেল ৬৬ হাজার টাকা।

বেসিকে জিএম পর্যায়ে মূল বেতন এক লাখ টাকা, ডিজিএমদের ৬৬ হাজার টাকা, এক্সিকিউটিভ অফিসারদের (প্রিন্সিপাল অফিসার সমমান) ৩৭ হাজার টাকা, সিনিয়র অফিসারদের ২৫ হাজার টাকা ও অফিসারদের ২০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে যথাক্রমে জিএমদের মূল বেতন ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা, ডিজিএমদের ৫০ হাজার টাকা, প্রিন্সিপাল অফিসারদের সাড়ে ৩৫ হাজার টাকা, সিনিয়র অফিসারদের ২০ হাজার টাকা ও অফিসারদের বেতন ১৬ হাজার টাকা।

অর্থাৎ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বেতন কাঠামোর চেয়ে বেসিক ব্যাংকের কর্মীদের বেতন বেশি ছিল।

বেতনে কতো সাশ্রয়

নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে এই খাতে ব্যয় কমেছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। দীর্ঘ দিন ধরে ব্যাংকের কর্মীরা সুবিধাবঞ্চিত।

সারা দেশে ৭২টি শাখা ও ২ হাজার ১০০ জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেসিক ব্যাংক।

২০১৪ সালের পর থেকে ব্যাংকের কর্মীদের কোনো প্রণোদনামূলক বোনাস দেয়া হয়নি। এমনকি চাকরি বিধিমালায় থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ব্যাংকে কোনো পদোন্নতি দেয়া হয়নি।

একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরি পেয়েও এখন হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।

বেসিক ব্যাংকে যোগদান করা নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মাত্র যোগদান করেছি। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। ব্যাংকের উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর