বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বহাল তবিয়তে শাহ আলম, এস কে সুর

  •    
  • ৩০ মার্চ, ২০২১ ২৩:২৫

ঘুষ নিয়ে পি কে হালদারকে সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। কিন্তু ব্যাংক হিসাব তলব ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেই তাদের বিরুদ্ধে। একজনের বিভাগ বদল হয়েছে। কিন্তু তিনি অফিস করছেন নিয়মিত।

একজন পূর্ণ সময় অফিস করছেন। সারছেন দাপ্তরিক কাজকর্ম। আর অন্যজন বাসাতেই কাটাচ্ছেন বেশির ভাগ সময়। প্রয়োজনে যাচ্ছেন বাইরেও। আদালতের মন্তব্য: এখনও কেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন না এই দুইজন?

ঘুষ লেনদেন এবং সহায়তার অভিযোগ ওঠা বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম এবং সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বহাল তবিয়তে আছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থ ‘পাচার’ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত পি কে হালদারকে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং থেকে ঘুষ লেনদেন এবং দুর্নীতিতে সহায়তা – এই দুই কারণে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান এবং সাবেক এই দুই কর্মকতা। এরই মধ্যে দুই জনের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর বেশি আর কোনো পদক্ষেপ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর, যার ক্ষমতার দাপটে চারিদিক কম্পমান ছিল, তাকে এখন চুরির দায়ে সবাই দূরে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা দক্ষ না, কাজ করে না, চুরি করে। এটা ভাবমূর্তির বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

কী বলেছেন রাশেদুল হক

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম অনিয়ম চাপা দিতে ঘুষ নিতেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকা অবস্থায় এ কে সুর চৌধুরী অনিয়ম ম্যানেজ করতেন।

একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী। তারপর নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন মহলে উঠে সমালোচনার ঝড়।

কী করছেন শাহ আলম

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে শাহ আলম নিয়মিত অফিস করছেন। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু তার বিভাগ বদলি করে তাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ছয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, অফিস করছেন শাহ আলম। অন্য কর্মকর্তারা জানান, নিয়মিত অফিস করলেও আগে শাহ আলমের কাজের যে ব্যস্ততা ছিল, এখন তেমনটি নেই। দায়িত্ব কিছুটা খর্ব হওয়ায় কর্মহীন থাকেন এই কর্মকর্তা।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন শাহ আলম। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পান ২০১৩ সালের অক্টোবরে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বেই ছিলেন তিনি।

তার মেয়াদে দেশের কমপক্ষে ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। বেশির ভাগ এখন টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন এস কে সুর চৌধুরী ও এস এম মনিরুজ্জামান।

বাসাতেই থাকেন এস কে সুর

সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী তার সেগুনবাগিচার বাসায় অবস্থান করছেন। আদালত, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা এবং সমালোচনার মধ্যেও আছেন সুস্থির। আইনি পথে হাঁটছেন সাবেক এই কর্মকর্তা। বিদেশ যাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। রিট করে তিনি সেই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছেন।

ডেপুটি গভর্নরের দাপট

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এক সময় সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী বা এস কে সুরের বিপুল দাপট ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি যাওয়ার পর আলোচনায় আসেন এই কর্মকর্তা। রিজার্ভ ইস্যুতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের মধ্যে তৈরি হয় আস্থার সংকট।

ওই বিরোধে অর্থমন্ত্রীর পক্ষ নেন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর। সচিবালয়ে তখন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক দিন বৈঠকও করেন তিনি। কয়েক দিনের মধ্যে রিজার্ভ কেলেংকারীর দায় নিয়ে ড. আতিউর রহমানকে সরে যেতে হয়।

রিজার্ভ কেলেঙ্কারি নিয়ে ড. ফরাসউদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে ড. আতিউর রহমানের দায় উঠে আসে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, রাষ্ট্রের এত বড় একটি ঘটনা এক মাস চেপে রাখেন ড. আতিউর রহমান।

নতুন গভর্নর আসার পরও কয়েক বছর এস কে সুর বাংলাদেশ ব্যাংকে তার দাপট বজায় রাখেন।

ব্যাংক হিসাব তলব

দেশের ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক কোনো ডেপুটি গভর্নর ও কর্মরত নির্বাহী পরিচালকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী এবং মো. শাহ আলম ও তার দুই স্ত্রী শাহীন আক্তার শেলী ও নাসরিন বেগমের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে সব ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে এদের সবার অ্যাকাউন্ট খোলার ফরম, লেনদেনসহ যাবতীয় তথ্য পাঠাতে বলা হয়।

এর আগে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা সেল।

চিঠিতে ওই দুই কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। চিঠিতে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের হিসাবের হালনাগাদ তথ্য চাওয়া হয়। এমনকি আগের ব্যাংক হিসাব কিন্তু এখন বন্ধ হয়ে গেছে– এমন হিসাবের তথ্যও দিতে বলা হয় তখন।

বিব্রত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি চাপা দেয়ার অভিযোগে প্রশ্নের মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।

নানা পর্যায়ে তারা এসব বিষয়ে জানতে চাইছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমান এবং সাবেক এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের খবরে বিব্রত সবাই। ভাবমূর্তির মারাত্মক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হবে তা কেউ জানে না।

কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতের তদারকি এবং নানাবিধ নির্দেশনা দেবার ক্ষেত্রেও সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।

যা বললেন দুদক আইনজীবী

দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর পি কে হালদারের সব অপকর্মের শেল্টার দিতেন। আর নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম প্রতি মাসে নিতেন দুই লাখ টাকা করে – পি কে হালদারের সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক আদালতে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন।’

খুরশীদ আলম বলেন, রাশেদুল হক আরও বলেছেন, এস কে সুর চৌধুরী ছিলেন পি কে হালদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। ডেপুটি গর্ভনর পদে থেকে তিনিই পি কে হালদারের সব অপকর্ম ঢেকে রাখতেন এবং তাকে আশ্রয় দিতেন।

পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সুকুমার মৃধা, অবান্তিকা বড়াল, শংক ব্যাপারিসহ বেশ কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করে পি কে হালদার বিভিন্নভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন।

দুদক থেকে এসব জবানবন্দির বিষয় জানিয়ে এস কে সুর ও শাহ আলমের ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দেয়া হয়েছে। বিএফআইইউ ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে।

ব্যাংক লেনদেনের তথ্যে যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সত্যতা মেলে তাহলে অবশ্যই তারা মামলার আসামি হবেন এবং গ্রেপ্তার হবেন বলে মন্তব্য করেন দুদকের আইনজীবী।

সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘২০০১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ক্ষমতা ছিল, এখন ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি। ২০০৯ সাল থেকে খেলাপি ঋণের উত্থান, রিজার্ভ চুরি ছাড়াও গত ছয়-সাত বছরে ব্যাংকিং খাতের প্রাইভেট ও পাবলিক সেক্টরে বিভিন্ন কেলেঙ্কারি হয়েছে। সরকারকে এসব বিষয় ভালোভাবে ভেবে দেখতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো ক্ষমতায়ন করা সম্ভব এবং এটা করা আশু কর্তব্য।’

এ বিভাগের আরো খবর