করোনার কারণে গত বছর পোলট্রি ব্যবসায়ীরা যে লোকসান গুনেছেন, এখন তারা তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন দাম বাড়িয়ে। শীতে মুরগির উৎপাদন কমে গিয়ে বাজারে সরবরাহ কিছুটা কমেছে।
করোনায় ক্ষতিতে পড়া ছোট খামারিরা বাজার থেকে ছিটকে পড়ার কারণেও বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।
এর বিপরীতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে পোলট্রি ফিডের দাম।
এ পাঁচ কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে সব ধরনের মুরগির দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে।
সাধারণত বাজারে সব ধরনের মুরগির দাম একসঙ্গে বাড়ে না। ব্রয়লার মুরগির দাম কিছু ওঠানামা করলেও সোনালি ও লেয়ার মুরগির দামে অস্থিরতা থাকে না। দেশি মুরগির বাজারও অনেকটা স্থির থাকে। তবে এবার সব ধরনের মুরিগর দাম একই সঙ্গে বেড়েছে।
দাম বাড়া শুরু হয় শীতের শুরু থেকে। তবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে দামের ঊর্ধ্বমুখী গতি বেড়েছে।
দাম কতটা বেড়েছে
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। এর দ্বিগুণ দামে প্রতি কেজি ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সোনালি মুরগি। আর ডিম পাড়া লাল ও সাদা লেয়ার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। দেশি মুরগির প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকায়।
ব্রয়লার মুরগির দাম এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা। ফাইল ছবিদেড় মাস আগে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছিল ২৪৫ থেকে ২৫০ টাকায়। দেশি মুরগি ৪০০ থেকে ৪২০ টাকায় এবং লেয়ার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
এ হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৪ শতাংশ দাম বেড়েছে সোনালি মুরগিতে। এর পরেই দেশি মুরগিতে বেড়েছে ২০ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সোনালি মুরগির দামও ৪৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
রাজধানীর বিজয় সরণির কলমিলতা বাজারের ক্রেতা রায়হান পারভেজ জানালেন, মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি আগের চেয়ে কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এক কেজির কাছাকাছি প্রতি হালি (সোনালি) মুরগির দাম পড়ত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে ঝামেলা এড়াতে একসঙ্গে এক হালি করেই কেনা হতো। কিন্তু এখন একই আকারের প্রতি হালি মুরগির দাম কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ টাকা। তাই হালির পরিবর্তে একটি বা দুটি কিনতে হচ্ছে।’
মুরগির দাম গরুর মাংসের চেয়েও বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক কেজি মুরগি জবাইয়ের পর ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম বাদ যায়। তাই এক কেজি মাংস পেতে দেড় কেজির বেশি মুরগি কিনতে হয়, যার দাম প্রায় ৫৫০ টাকা। অথচ এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৫৮০ টাকা।’
শীতে উৎপাদন কমে
প্রতিবছর শীতের পর সাধারণত মুরগির দাম কিছুটা বাড়ে। শীতে ফ্লুর কারণে মুরগির উৎপাদন কম হয়। পাশাপাশি অনেক মুরগির বাচ্চা মারা যায়। এ সময় মুরগির বাচ্চার বৃদ্ধি কম হয়। তাই খামারিরা খামারে কম বাচ্চা তোলেন।
সোনালি ও দেশি মুরগির দামেও হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। ফাইল ছবিখামারে মুরগি বাচ্চা থেকে বাজারজাত করতে ব্রয়লার মুরগিতে ৩৫ দিন থেকে দেড় মাস, সোনালিতে দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। তাই শীতের পর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কারণে বাজারে মুরগির দাম বেড়েছে।
করোনার ধাক্কা
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এপ্রিলে মুরগি বিক্রি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ফলে একদিকে বেশি সময় মুরগি পালন করার কারণে ব্যয় বেশি হয়েছে। আবার চাহিদা কম থাকায় খামারের মালিকরা কখনও অর্ধেক দামে মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বাজার না থাকায় খামারিরা বাচ্চা না তুলে খামার বন্ধ রাখেন। এতে হ্যাচারির মালিকেরাও পড়েন বিপাকে। অনেক হ্যাচারি এক দিনের বাচ্চা বিক্রি করতে না পারায় সেগুলো মারা যায়। ফলে খামারি ও হ্যাচারির মালিকেরা অনেকে মূলধন হারিয়েছেন।
গত জুনে সাধারণ ছুটি অবসানের পরও খামারির বাচ্চা ও মুরগি উৎপাদন আগের পর্যায়ে যায়নি।
পোলট্রি খাতের সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মুরগির বাজারে ব্রয়লারের অংশ ৬০ শতাংশ। সোনালি ৩০ শতাংশ এবং লেয়ার, দেশিসহ অন্য জাতের মুরগি বিক্রি হয় ১০ শতাংশ। প্রতি সপ্তাহে দেশে মুরগির বাচ্চার চাহিদা ২ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে দেড় কোটি ব্রয়লার, ৮০ লাখ ফাওমি সোনালি ও ৫ লাখ হাইব্রিড সোনালি।
লোকসান পুষিয়ে নিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা
করোনাকাল ও সাধারণ ছুটি চলাকালে মুরগির দাম উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম ছিল। তখন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ৮০ টাকাতেও নেমে এসেছিল।
খামারিদের দাবি, এক কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচ ১১০ টাকার কাছাকাছি। ফলে তখন কেজিতে লোকসান গুণতে হয়েছে প্রায় ৩০ টাকার মতো।
এখন বাড়তি দাম নিয়ে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে খামারে ব্রয়লার মুরগি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকার মতো লাভ করছেন খামারিরা। আগে মুনাফা ছিল কেজিতে গড়ে ৫ টাকার মতো।
এক কেজি মাংস পেতে দেশি মুরগিতে দেড় কেজি কিনতে হয়, সেই হিসাবে এর দাম পড়ে এক কেজি গরুর মাংসের সমানকরোনার কারণে যেসব খামার লোকসানে পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট খামারিরা। তারা অনেকটাই পথে বসার অবস্থায়। এ ধরনের ৩০ শতাংশ ছোট খামার এখনও চালু হয়নি বলে জানায় খামারিদের বিভিন্ন সংগঠন।
করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে এই ভয়ে অনেকে খামারে মুরগির বাচ্চা তুলছেন না। অথচ মুরগরি প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান আসে গ্রামীণ প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি থেকে। ছোট খামারিরা উৎপাদনে না থাকায় বাজার বড় খামারিদের দখলে রয়েছে। তারা প্রতিদিনের দাম ঠিক করছে।
মধ্যস্বত্বভোগীরাও মুনাফা বাড়াচ্ছেন
উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বড় ভূমিকা থাকে মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। তারাই খামার থেকে সংগ্রহ করে তা বাজারে সরবরাহ করেন। কিন্তু এখন মধ্যস্বত্বভোগীরা আগের চেয়ে বেশি লাভ করছেন।
দাম বাড়ার আগে খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতো ১০০ থেকে ১০৫ টাকায়। সে মুরগি দুই হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বিক্রি হতো ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় খামার থেকে কেনা ব্রয়লার মুরগি খুচরা বাাজরে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়।
আবার আগে খামার পর্যায়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি খুচরা বাজারে বিক্রি হতো ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। কিন্তু সোমবার খামার পর্যায়ে ২৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৪০ টাকায়। বিক্রি কম হলেও মধ্যস্তরের ব্যবসায়ীরা লাভ করছেন বেশি।
সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা বেড়েছে
জানুয়ারিতে করোনা সংক্রমণ স্বল্প সময়ের জন্য কমে আসায় তখন নানা অনুষ্ঠান আয়োজন বেড়ে যায়। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে নানা পদের রান্নায় সোনালি মুরগিই বেশি ব্যবহার হয়।
পর্যটন এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে সোনালি ও দেশি মুরগির ব্যবহার বেশি হয়। আবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচির পরিবর্তন। এ শ্রেণির মানুষজন আগে ব্রয়লার মুরগিতে অভ্যস্ত হলেও গত কয়েক বছর দাম নাগালে থাকায় তারা সোনালি মুরগিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে এখন সোনালি মুরগির চাহিদায় বেড়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসীন জানান, এবার শীতে শেষে সামাজিক অনুষ্ঠান বেড়ে যাওয়ায় মুরগির চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশের মতো। একদিকে কম উৎপাদন অপরদিকে বাড়তি চাহিদা দাম বাড়িয়েছে।
বেড়েছে খাবার ও বাচ্চার দাম
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিঅ্যাব) বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়তি থাকায় মুরগির খাবার বা পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। পোলট্রি ফিডের কাঁচামালের দাম কেজিতে ১২ টাকা বেড়েছে। সেই সঙ্গে জাহাজভাড়া মিলে ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে। এতে দেশের বাজারে ফিডের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি কেজি ফিড গড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৭ টাকার ওপর।
পোলট্রি খাদ্য তৈরির উপকরণ ভুট্টা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ২৭ টাকায় এবং মিটবোন মিল ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার আমদানি করা ফিডের কাঁচামাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়। খালাসে দেরি হওয়ায় দাম বেড়ে যায়।
এখন বাচ্চার দামও বেড়েছে। সর্বোচ্চ ৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা, যা স্বাভাবিক সময়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে থাকে।
খামারিদের দাবি, খাবার ও বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে ব্রয়লারেরদাম বাড়লেও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ বাড়েনি বলে জানান কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. শাহীন। তিনি বলেন, ‘আগে এক খাঁচা মুরগি কিনলে যে পরিমাণ লাভ হতো, এখন তার অর্ধেকে নেমেছে। বেশি দাম হওয়ায় পাইকারি বাজার থেকে বেশি টাকা খরচ করে মুরগি কিনতে হচ্ছে। অপরদিকে ক্রেতারাও কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।’
বাজারে বড় মুরগি কম আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৬৫০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের সোনালি মুরগি এবং দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি পাওয়া যেত। এখন দাম বেশি হওয়ায় ছোট মুরগিই বেশি আসছে। বাজারে আসা বেশিরভাগ সোনালি মুরগি ৬৫০ থেকে ৭০০ গ্রামের এবং ব্রয়লার মুরগি এক কেজির কাছাকাছি।’
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রমজান ও ঈদ বাজারের ভালো দামের আশায় অনেকে দেরিতে খামারে মুরগি তুলেছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর মুরগি বাজারে আসবে। তাই দাম কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে বর্তমানে করোনার সংক্রমণ আবারও বেড়ে গেলে খামারিরা গতবারের মতো পথে বসবে। তাই ব্যবসায়ীদের মুরগি ধরে না রেখে বিক্রি করে দেয়া উচিত।’