দেশ থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে নানান টালবাহানা থাকলেও বিদেশি ঋণ পরিশোধে গতি বেশ। ফলে এ খাতে খেলাপি ঋণও কম।
করোনার এ সময়েও মূল ব্যাংকিংয়ে ঋণ বাড়লেও অফশোর ব্যাংকিংয়ে সে অবস্থা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অফশোর ব্যাংকিংয়ের অন্তর্ভুক্ত ৩৬ ব্যাংক ৬৩ হাজার ২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে মোট শ্রেণীকৃত ঋণ ৪৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা মোট ঋণের দশমিক ৭২ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরের তুলনায় ব্যাংকের অফশোর বিভাগের খেলাপি ঋণ ডিসেম্বরে ১৯ লাখ টাকা বেড়েছে।
গত ডিসেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ উৎসে ঋণস্থিতি বেড়ে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি ঘোষণা করা যাচ্ছে না আদালতে মামলা থাকায়। আবার আদায় অনিশ্চিত থাকায় অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও কম নয়।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণ অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই উদ্যোক্তারা নেয়। এ জন্য এ খাতে ঋণ পরিশোধের রেকর্ডও ভালো।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার এ সময়েও অফশোর ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড খুব ভালো। এখানে খেলাপি ঋণও খুব কম।’
সুদের হার কম বলে বিদেশি ঋণে আগ্রহ বেড়েছে গত এক দশকে। তবে বিষয়টি এত সরল নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডলারে এই ঋণ আনা হয় আর ডলারেই পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বিনিময় হারের কারণে কখনও কখনও অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হতে পারে।
গত দুই বছর টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময়হার স্থিতিশীল থাকলেও আগের তিন বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি।
ফলে পাঁচ বছর আগে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের কেবল বিনিময় হারের কারণে ১০ শতাংশ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিনিময় হার যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে বিদেশি ঋণ দ্রুত পরিশোধ করা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট শামস মাহমুদ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে গেলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ বেড়ে যায়। এ জন্য এসব ঋণ আমরা দ্রুত পরিশোধ করার চেষ্টা করি।’
বিদেশ থেকে দেশি উদ্যোক্তাদের ঋণ সংগ্রহের সুযোগ প্রায় চার দশক আগেই করে দেয়া হয়েছে।
১৯৮৫ সালে ‘অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট’ নামে ব্যাংকের আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়।
তবে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বড় জোগানদাতা বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো। বর্তমানে ৩৬টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং বিভাগ গঠন করে ঋণ এই বিতরণ করছে।
ডিসেম্বর শেষে এ ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি এবি, ব্র্যাক, ঢাকা, প্রাইম ও বিদেশি উরি ব্যাংকের অফশোরর বিভাগে খেলাপি ঋণ রয়েছে।
তবে ডিসেম্বর শেষে অফশোর বিভাগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি কমে ৩৮ হাজার ৪৩২ কোটি টাকায় নেমেছে। গত জুন শেষে যা ছিল ৩৪ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা।
ঋণস্থিতি কমলেও আগের মতোই বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৪৫ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০৯ কোটি টাকা রয়েছে এবি ব্যাংকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০২ কোটি টাকা ব্র্যাক ব্যাংকে। ঢাকা ব্যাংকে রয়েছে ১০ কোটি টাকা এবং প্রাইম ব্যাংকে রয়েছে ৮ কোটি টাকা।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি ২৭ হাজার ৫৬৭ কোটি থেকে কমে ২৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এ খাতের একমাত্র উরি ব্যাংকে ৬ কোটি ৯ লাখ টাকা খেলাপি রয়েছে।
তবে অফশোর বিভাগে মোট ঋণের বিপরীতে রক্ষিতব্য ও রক্ষিত প্রভিশনের পরিমাণ যথাক্রমে ৯০৩ কোটি ৬৬ লাখ ও ৯০৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এ ক্ষেত্রে প্রভিশন উদ্বৃত্ত এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি নেই।
দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় অফশোর বিভাগে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। অপরদিকে দেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে ইস্টার্ন, সিটি, ব্র্যাক, এবি ও ইসলামী ব্যাংক।
অগ্রণী, আল-আরাফাহ, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, ডাচ-বাংলা, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, প্রাইম, পূবালী, শাহজালাল, সোশ্যাল ইসলামী, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউসিবি, উত্তরা, সিটি এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও উরি ব্যাংকের মাধ্যমেও এ ঋণ দেয়া হয়।
করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে ২০২০ সালে পুরো বছরজুড়ে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করেনি ব্যাংকগুলো।
২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলসহ নানা সুবিধা দেয়া হয়। যে কারণে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে খেলাপি ঋণ কমেছে।