করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় লকডাউন ও পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ হচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর বড় দরপতন হলো পুঁজিবাজারে।
যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নিশ্চিত করেই বলেছে, লেনদেন স্থগিতের কোনো পরিকল্পনা নেই। আর সরকারও স্পষ্ট করে বলেছে, লকডাউনের কোনো পরিকল্পনা নেই।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়ার পরও সরকার লকডাউনে যায়নি। তবে সে সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছুটির ওই সময় পুঁজিবাজারেও লেনদেন স্থগিত থাকে। আর এর আগে বাজারে ব্যাপক দরপতনও দেখা দেয়।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে করোনার সংক্রমণ আবার বেড়েছে। এক মাস আগে পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হার যেখানে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে, সেখানে এবার সংক্রমণের হার বেড়ে হয়েছে ১০ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর লকডাউন ঘোষণাসহ ১২টি প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন স্পষ্ট করেই বলেছেন, সরকার লকডাউনে যাচ্ছে না।
তবু পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। বিশেষ করে যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে লেনদেন করে, দুশ্চিন্তা বেশি তাদের। লেনদেন স্থগিত হলে সুদের চাপ বাড়বে- এই অবস্থায় বিক্রয়ের চাপ বেড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে লেনদেনের শুরুতেই কমে যায় বেশিরভাগ শেয়ারের দর। ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারও ধরে রাখতে পারেনি দাম। আর এই পরিস্থিতিতে সূচকের বড় পতন হয়।
বিনিয়োগকারী আব্দুল্লাহ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন করে লকডাউন দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজারে আলোচনা হচ্ছে, লেনদেনও বন্ধ করে দেয়া হবে।’
এক পর্যায়ে সূচক ১০০ পয়েন্ট নেমে যায়। তবে বিএসইসির পক্ষ থেকে ‘লেনদেন বন্ধ হচ্ছে না’ বলে বক্তব্য আসার পর শেষ ২০ মিনিটে কিছুটা উদ্ধার হয় সূচক।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গুজবের তথ্য আমাদের কাছেও এসেছে। তবে কমিশন এখন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধের বিষেয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বন্ধের কোনো পরিকল্পনাও নেই।
‘যত দিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চলবে, ততদিন পুঁজিবাজারেও লেনদেন হবে। এখানে গুজবে পড়ে লেনদেন না করা বা বিনিয়োগ না করার কোনো কারণ নেই।’
সূচক ও লেনদেনে প্রভাব
ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৬০ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ২৯টির আর সিএসইতে লেনদেন ২৩২টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৮টির।
এত বেশি কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের প্রভাবে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৮১ দশমিক ৭১ পয়েন্ট।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৩৪ পয়েন্টে। শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৩ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৪৭ পয়েন্টে। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৩৭ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩ পয়েন্টে।
গত ৫ সপ্তাহের মধ্যে এটিই সূচকের সবচেয়ে বড় পতনের একটি। গত মাসের ৭ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে সূচকের পতন হয়েছিল ১৪৩ পয়েন্ট এবং তারপর দিন ৮ ফেব্রুয়ারি পতন হয়েছিল ১২৮ পয়েন্ট। আর গত ২৬ জানুয়ারি সূচকের পতন হয়েছিল ৯৪ পয়েন্ট।
বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বিক্রয় চাপে কমে যায় সূচক। পড়ে যায় বেশিরভাগ শেয়ারের দর
ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৬৮৪ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬৯৮ কোটি টাকা। ফলে আগের দিনের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ১৪ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে-সিএসইর প্রধান সূচক সিএএসপিআই ২১৭ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৫০ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ২৩২টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৮টির, কমেছে ১৬০টির ও পাল্টায়নি ৪৪টির। লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র একটির। আর পর পাল্টায়নি ছয়টির। বাকি ২৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর কমেছে।
আর্থিক খাতে তালিকাভুক্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের দর বেড়েছে। দর পাল্টায়নি পাঁচটির। বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর কমেছে।
কারিগরি ত্রুটি
লেনদেন শুরুর পর প্রায় ৪০ মিনিট ডিএসই ওয়েবসাইটে কারিগরি ক্রটি দেখা দেয়। এ সময় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পরিপূর্ণ তথ্য প্রদর্শন হয়নি।
এ কারণে সূচক ও লেনদেন কমেছে কি না প্রশ্নে ডিএসইর উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবসাইটের সঙ্গে লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে লেনদেনে প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই।’
বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘সকালে ডিএসই ওয়েবসাইটে সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান বলা হয়। এবং দ্রুতই তা সমাধান হয়েছে। এর কারণে লেনদেনে কোনো প্রভাব পড়েনি।’
বিশ্লেষকদের বক্তব্য
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে বিষয়গুলোকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে পুঁজিবাজারে পতন হচ্ছে সেটির অনেকটাই সুরাহা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর জন্য লভ্যাংশের সীমা পরিবর্তন করে নির্দেশনা জারি করেছে। তবে এক্সপোজার লিমিট নিয়ে কোনো কিছু না বললেও ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়া উচিত ছিল।
‘কেন বাড়িনি সেটাই প্রশ্ন।’
এমটিবি ক্যাটিপাল লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিব ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী খায়রুল বাশার মোহাম্মদ আবু তাহের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এখন পতন হওয়ার মতো বিশেষ কোনো কারণ নেই। বাংলাদশে ব্যাংকের সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলোর সবগুলোই পুঁজিবাজারবান্ধব। কিন্ত এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পর্যন্ত অবগত করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। কারণ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই মুনাফার জন্য লেনদেন করে থাকেন। যেখানে মুনাফা হবে সেখানেই বিনিয়োগ করেন। এর ফলে পুঁজিবাজারে কম দামি শেয়ারগুলোর দর বাড়ছে।’
লেনদেনে এগিয়ে বেক্সিমকো রবি
লেনদেনের শীর্ষস্থানে আবার বেক্সিমকো লিমিটেড ও রবি আজিয়াটা। বেক্সিমকো লিমিটেডের ১ কোটি ৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৭টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮২ কোটি ৩৪ লাখ টাকার।
রবি আজিয়াটার ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৬ কোটি ৩১ লাখ টাকায়।
এ তালিকায় ছিল বেক্সিমকো ফার্মা, যার মোট ২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকারে শেয়ার লেনদেন হয়েছে। লংকাবাংলা ফিন্যান্সের ২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা, লাফার্জ হোলসিমের ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদনে হয়েছে।
আগ্রহ ও অনাগ্রহের কোম্পানি
টানা দুই কার্যদিবস সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আজিজ পাইপের দর। লোকসানী ও যৎ সামান্য লভ্যাংশ ঘোষণা করা এই কোম্পানির শেয়ার দর পর পর দুই দিন সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৭ টাকা ৯০ পয়সা।
লিগাসি ফুটওয়ারের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। স্টাইলক্রাফটের দর বেড়েছে ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ।
কোম্পানিটি দীর্ঘদিন বিএসইসির বেধে দেয়া সর্বনিম্ম দর ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়েছিল। এছাড়া দেশ বন্ধু পলিমার লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
দর পতনের দিক দিয়ে বৃহস্পতিবার শীর্ষে ছিল পিপলস ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
নতুন শেয়ার লুব রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। ফাইনফুডের শেয়ার দর কমেছে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, এসএস স্টিল, বে লিজিং, রূপালী ইন্স্যুরেন্স ছিল দর পতনের থাকা কোম্পানির তালিকায়।