বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নারীদের হাতে প্রাণ ফেরা সেই ‘গয়না গ্রাম’-এর গল্প

  •    
  • ১৫ মার্চ, ২০২১ ১২:০৭

খুশি জানান, পাড়ার অন্যদের কাছ থেকে দেখে দেখে শেখা গয়না তৈরির কাজ। ২০১৮ সালে স্বামী আবু বক্কর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে গয়না বানিয়েই সংসারের হাল ধরেন খুশি। নিত্যদিনের খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা জমিয়ে দুই লাখ টাকায় গড়ে তুলছেন নিজেদের বাড়িও।

বগুড়া শহরের ধরমপুর পূর্বপাড়ার গৃহবধূ খুশি বেগম। ঘরের কাজ শেষ করে বিকেলে অবসরে তামা ও পিতল দিয়ে গয়না বানান তিনি। সযত্নে নিখুঁতভাবে কানের দুলে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন নানান নকশা।

তার জা ফেন্সি বেগমও কাজ করেন তামা-পিতল নিয়ে। তিনি মূলত গলার মালা ও সীতাহার বানান।

এগুলো অ্যান্টিক গয়না হিসেবে পরিচিত। খুশি ও ফেন্সি এই গয়না বিক্রি করে সংসারের আয়ের খাতায় যোগ করেছেন নিজ নিজ অবদান।

নিউজবাংলাকে খুশি জানান, পাড়ার অন্যদের কাছ থেকে দেখে দেখে শেখা এই কাজ। ২০১৮ সালে স্বামী আবু বক্কর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে গয়না তৈরি করেই সংসারের হাল ধরেন খুশি। নিত্যদিনের খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা জমিয়ে দুই লাখ টাকায় গড়ে তুলছেন নিজেদের বাড়িও।

খুশি বেগম বলেন, তার দৈনিক গড়ে ৪০০ টাকা রোজগার হয়।

খুশির জা ফেন্সি বেগম বলেন, ছয় বছর ধরে তিনি অ্যান্টিক গয়নার কাজ করছেন। স্বামী জহুরুল ইসলামও এই কাজ করেন। প্রতিদিন দুজনে মিলে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করেন।

গয়না গ্রামের নারীরা ঘরের কাজের ফুসরতে বসে যান গয়না বানাতে। ছবি: নিউজবাংলা

ফেন্সি বলেন, ‘ঘরে বসে থেকে শখে এই কাজ করি। যে টাকা আয় হয় তা সঞ্চয় করি। এ থেকে আমি ইটের বাড়ি করছি। তিন শতক জমি কিনছি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালাই। স্বামী-সংসারের অন্য খরচও সামলাই।’

খুশি ও ফেন্সির মতো গল্প আছে এই গ্রামের অনেক নারীরই। এখানকার অন্তত ৪০ হাজার বাসিন্দা অ্যান্টিক গয়না তৈরি করে উপার্জন করছেন। এর মধ্যে ৩৫ হাজারেরও বেশি গয়না শ্রমিক হচ্ছেন নারী। ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে দিয়েছেন এই তথ্য।

তার কাছ থেকে জানা গেল ধরমপুর গ্রামের ‘গয়না গ্রাম’ হয়ে ওঠার ইতিহাস।

প্রায় দেড় শ বছর আগে এই গ্রামে গয়না তৈরির কাজ শুরু হয়। সে সময় পিতলের গয়নাই বেশি তৈরি হতো।

একপর্যায়ে সোনার গয়নার চাহিদা বাড়তে থাকলে এখানকার শ্রমিকদের কাজ কমে যায়। ’৮০-এর দশকের শেষে যখন সোনার গয়নার চাহিদায় ভাটা পড়তে থাকে, তখন আবার চাঙা হন এই গ্রামের অ্যান্টিক গয়নাশ্রমিকরা।

২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের দিকে জমজমাট হয়ে ওঠে এই কাজ। অ্যান্টিকের গয়নাকে ঘিরে গড়ে ওঠে ধরমপুর বাজারের মোকাম।

এই বাজারে গয়নার ২৩৮টি দোকান আছে। ধরমপুর বাজারে মালিক-শ্রমিক মিলে প্রায় ৩ হাজার মানুষ সেখানে কাজ করেন।

গয়না গ্রামে তৈরি অ্যান্টিকের এসব গয়নার চাহিদা দেশজুড়েই। ছবি: নিউজবাংলা

এখান থেকে তৈরি গয়না যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-রংপুর-খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি রমজান আলী সরদার জানান, এই বাজারে এখন প্রতিদিন অন্তত ৫০ লাখ টাকার গয়না পাইকারি বিক্রি হয়। সে হিসেবে মাসে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় গয়নাকে কেন্দ্র করে; বছর শেষে যার পরিমাণ হয় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীদের থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে শ্রমিকরা ঘরে বসেই বানান এসব গয়না। এর মধ্যে অনেকে আবার নিজ উদ্যোগে ঘরেই গড়ে তুলেছেন ছোটখাটো কারখানা। সেখানে একসঙ্গে পাড়ার কয়েকজন শ্রমিক মিলে কাজ করেন। এই উদ্যোক্তা-শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী।

অ্যান্টিক গয়নার কাজ ধরমপুরে শুরু হলেও এখন এই শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সদরের নিশিন্দারা, ঝোপগাড়ী, ফুলবাড়ী, বারোপুরসহ অনেক এলাকায়। এসব এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছে গয়নাশিল্পকে ঘিরে।

কারিগরদের কাছ থেকে জানা গেছে, অ্যান্টিক এসব গয়নার চাহিদা এখন ব্যাপক। এগুলোর মধ্যে আছে সীতাহার, শাড়ীমালা, কান্দা, লহর, হাশলি, জড়ো, টায়রা, টিকলি, চুড়, বালা, মানতাসা, নূপুর, বিছাসহ প্রায় ১০০ ধরনের গয়না।

গয়নার কাজ করতে নিজ ঘরেই কারখানা গড়ে তুলেছেন অনেক নারী। ছবি: নিউজবাংলা

ধরমপুরের পাশেই বারপুর গ্রামের এমনই এক গয়নার কারখানায় কাজ করেন রমিচা বেওয়া। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গত তিন বছর গয়নার কাজ করছেন। সংসারের সব খরচ তিনিই মেটান। প্রতি মাসে তার আয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।

ধরমুপর, নিশিন্দারা, ঝোপগাড়ি, আটাপাড়া এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীও লেখাপড়ার পাশাপাথি গয়নার কাজ করেন।

সরকারি মুজিবর রহমান মহিলা কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আদুরী আক্তার থাকেন নিশিন্দারা উত্তর পাড়ায়। তিনি বলেন, অ্যান্টিকের গয়না তৈরি করেই নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগান।

উচ্চমাধ্যমিকপড়ুয়া পল্লি মঙ্গল এলাকার সাদিয়া বলেন, ‘শখ থেকে মূলত এই কাজ শুরু। এখন সময়ও কাটে, টাকাও উপার্জন হয়।’

ধরমপুর বাজারের শফিক গোল্ড অ্যান্ড অ্যান্টিক জুয়েলার্সের মালিক শফিকুল ইসলাম এই বাজারে দোকান দিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর হলো। তিনি জানালেন, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকার গয়না তার দোকান থেকেই বিক্রি হয়।

গয়না শিল্পকে ঘিরে গ্রাম গড়ে উঠেছে বাজার। ছবি: নিউজবাংলা

ঢাকার গাজীপুর থেকে এই বাজারে পাইকারি দরে গয়না কিনতে এসেছেন জীবন মিনসা। তিনি বলেন, গাজীপুরের টঙ্গী বাজারে তার দোকান। এই অ্যান্টিক গয়নার এখন চাহিদা বেড়েছে। এই এলাকার গয়নার সুনাম শুনে তিনি এসেছেন।

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধরমপুর এলাকায় গয়নার ব্যবসা করেন রমজান আলী সরকার। তিনি ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, গয়নার কাজে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভালো। কম বেতনে তাদের পাওয়া যায়। আবার ঘরের কাজ করে নারীরা এসব কাজ করতেও পারে।

গহনা গ্রামের নারীদের উৎসাহিত ও দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান বাড়াতে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান জেলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম।

এ বিভাগের আরো খবর