কাজের ফাঁকে দিনের নানান সময়ে ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুঁ মারেন গৃহিণী সানজিদা আক্তার। একদিন ফেসবুকের একটি পেজে হঠাৎ-ই চোখ আটকে যায়। দেখতে পান, পোশাক বিক্রির একটি পেজ থেকে দেয়া হচ্ছে লোভনীয় অফার। দাম এবং পোশাকের রং পছন্দ হওয়ায় অর্ডারও দিয়ে দেন সানজিদা। কিন্তু হাতে পাওয়ার পর তাজ্জব বনে যান এই ক্রেতা। বলেন, ছবির সঙ্গে বাস্তব রঙের কোনো মিল নেই। কাপড়ের মানও দামের উপযোগী না।
সানজিদার মতো অনলাইনে পণ্য কিনে হরহামেশাই ঠকছেন ভোক্তা। করোনায় ঘরবন্দি মানুষের বেড়েছে অনলাইননির্ভরতা। ঘরে বসে বিপুলসংখ্যক মানুষ করছেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। তবে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ন হচ্ছে ক্রেতাস্বার্থ। মানহীন পণ্য বিক্রি, এক পণ্যের কথা বলে অন্য পণ্য দেয়া এবং অতিরিক্ত দাম নেয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ।
শিল্পী তৌফিক এলাহী নিয়মিত অনলাইনে শপিং করেন। তিনি বলেন, ‘কোনো পণ্য অর্ডার করলে প্রায়ই রং থেকে শুরু করে নানা স্পেসিফিকেশন মেলে না। তখন এই পণ্য রিপ্লেসমেন্ট কঠিন হয়ে যায়। যোগাযোগ করলে সাড়া পাওয়া যায় না। নানাভাবে ঘোরানো হয়।’
তৌফিক এলাহী জানান, ছোট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বড় বড় নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুম আরেফিন নিউজবাংলাকে জানান, করোনায় অনলাইনকেন্দ্রিক ব্যবসা বেড়েছে। আর যত বিক্রি বেড়েছে, ততই বেড়েছে অভিযোগ।
তিনি জানান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে এখন যত অভিযোগ আসে, তার অর্ধেকের বেশিই আসে অনলাইন প্রতারণাকেন্দ্রিক। পণ্য কিনে কোনো ক্রেতা প্রতারিত হলে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ই-কমার্সভিত্তিক অভিযোগের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। আর গত প্রায় তিন বছরে এই সংখ্যা ৮ হাজার ৪০০ ছাড়িয়েছে, যার ৮৫ ভাগই নিষ্পত্তি করেছে সংস্থাটি।
ভোক্তারা যদি অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন, তাহলে তদন্তে সেবাদানকারীকে জরিমানা করা হলে, আদায়কৃত জরিমানার ২৫ ভাগ অভিযোগকারী ভোক্তা পান।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা অধিকারে ৬ হাজার ৬০০-এর বেশি অভিযোগকারীকে জরিমানাকৃত টাকার ২৫ ভাগ অর্থাৎ ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ই-কমার্সের বাইরে বাজারে পণ্যমূল্য, মান অথবা ওজন; সবকিছুতেই সন্দেহ। যৌক্তিক মূল্যে কি পণ্য মিলছে? যদি মেলেও তার মান কি ঠিক আছে? নানা রকমের ওজন যন্ত্রের ব্যবহারে পণ্যের সঠিক পরিমাপ করা মুশকিল।
ভোক্তা বনাম পণ্যবিক্রেতা–এই টানাপোড়েনের মধ্যে এসেছে ‘বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস’। ‘মুজিববর্ষে শপথ করি, প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি’ এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সোমবার দিবসটি পালনে প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। প্রচারণা এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা নিউজবাংলাকে জানান, ভোক্তাস্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অনেক ভোক্তাই তার অধিকার সম্পর্কে এখন সচেতন। প্রতিবাদ করছেন, অভিযোগও দিচ্ছেন। তবে, বাজারব্যবস্থায় বহুমুখীতার কারণে প্রতারণার ধরনও বদলে যাচ্ছে।
কনজ্যুমার ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক জানান, অতি মুনাফার প্রবণতা, রাতারাতি টাকার মালিক বনে যাবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বাজারব্যবস্থায় বাড়ছে অনিয়ম।
তিনি বলেন, পণ্য কেনাবেচা এবং মানের দিক থেকে ক্রেতাস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কঠোর তদারকি ছাড়া ভোক্তার সুরক্ষা মেলা অসম্ভব।
দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া অনলাইন কেনাকাটাতে পণ্য যাচাইয়ের সুযোগ কম। তাই সম্প্রতি ভোক্তা বঞ্চনার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পণ্য কিনতে গিয়ে নিম্নমান, উচ্চমূল্য, অন্যায্য ভ্যাট, ওজন কম এমন নানা কারণেই প্রতারিত হন ক্রেতা। শুধু অনলাইনে কেনাকাটায় নয়, সব ধরনের পণ্য কেনার ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত ভোক্তা। আসল-নকল কিংবা দামের মারপ্যাঁচ থেকে কতটা রক্ষা পাওয়া যায় সব সময় সেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষায় আইন এবং পৃথক অধিদপ্তর হলেও কমছে না প্রতারণা।
একাধিক ভোক্তা জানান, মানহীন পণ্য বেশি টাকায় গছিয়ে দেয়া হয়। নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তবে, তদারকির অভাবে সুফল মিলছে কমই।
ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত না করার ১৭ ধরনের অপরাধে ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ছবি: সংগৃহীত
ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত না করার ১৭ ধরনের অপরাধে ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চলতি অর্থবছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজার অভিযানের সংখ্যা ৯ হাজার ৮৫১টি। আর এ সময়ে সাজা দেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৯৫৮টি। জরিমানার পরিমাণ ১০ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার ৭০০ টাকা। এ সময় অভিযোগ করা হয় ৬ হাজার ৮২৭টি।
প্রতিষ্ঠার পর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪১ হাজার ১০৭টি বাজার অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আর দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৭ হাজার ৩০৯।
এ সময় জরিমানা আদায় হয় ৬৮ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার। সব মিলিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে ৩৯ হাজার ৮০১টি। আর অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৭ হাজার ৯০৯টি।