করোনাকালীন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা করতে বেশি ব্যয়ের লক্ষ্য নিয়ে এবার বড় বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। এই বাজেট অর্থায়নে বিশাল রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরে সরকার রাজস্ব আদায়ে যে প্রবৃদ্ধি ধরেছে, বাস্তবে আদায় তার ধারেকাছে নেই। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিরাট তফাত দেখা যাচ্ছে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৪০ শতাংশের বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে রাজস্ব আয় বাড়ছে মাত্র ৫ শতাংশ হারে। অর্থাৎ প্রাাক্কলন ও আদায়ের মধ্যে ঘাটতি ৩৫ শতাংশ।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে বেশি রাজস্ব আসে। এটা বাংলাদেশের রাজস্ব খাতের স্বাভাবিক প্রবণতা। তবে এবার ঘাটতি একটু বেশি হবে। করোনার ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে না পারায় এমনটা হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবছরের মতো এবারও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের মূল লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৯ শতাংশ বা ৩০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ কোটি টাকা।
গত সপ্তাহে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এনবিআরকে।
রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের আট মাসে এনবিআরের মাধ্যমে মোট আহরণ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। পরবর্তী চার মাসে অবশিষ্ট রাজস্ব আদায় করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, বছরের বাকি সময়ে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে কি না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় দুর্বলতা হচ্ছে, রাজস্ব খাত এবং অর্থনীতির সঙ্গে রাজস্ব আদায় সমাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার না করলে কাঙ্ক্ষিত আয় বাড়বে না। কিন্তু বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।’
চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অতি উচ্চাভিলাষী আখ্যায়িত করে তিনি আরও বলেন, যেভাবে আদায় বাড়ছে, তাতে বছরের শেষে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি আহরণ হবে না।
রাজস্ব বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অর্থবছর শেষে এবার ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি বাড়লে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও কাছাকাছি যাওয়া যাবে।
এবারের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর ও এনবিআর-বহির্ভূত দুটি উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করে বাজেটে অর্থায়ন করে থাকে সরকার।
এর মধ্যে এনবিআরের অবদান ৮৬ শতাংশ। বাকি ১৪ শতাংশ ভূমি কর, স্ট্যাম্প ফিসহ নানা খাত থেকে আদায় করা হয়, যাকে এনবিআর-বহির্ভূত কর বলে। করোনার কারণে দুটি খাতেই এবার বিশাল ঘাটতি হবে।
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর ও আমদানি শুল্ক–এই তিন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করে থাকে এনবিআর। এই তিনটি খাতে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়েছে।
এর মধ্যে ভ্যাট আদায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা, আয়কর ৯৭ হাজার কোটি টাকা ও আমদানি শুল্ক ৯৪ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্বের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ কোটি টাকা, যা মূল লক্ষ্যমাত্রার ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ কম।