বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১৬ হাজার কোটি ঘণ্টার কাজ, নেই স্বীকৃতি

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২১ ০৯:৫৯

গৃহস্থালিকাজে দেশের নারীরা বছরে ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন, যার আর্থিক মূল্যমান ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এই আর্থিক মূল্য যোগ হলে জিডিপিতে নারীর অংশ বর্তমানের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশে।

নাজমা আক্তার। পেশায় গৃহকর্মী। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে দুপুর পর্যন্ত মিরপুরের শেওড়াপাড়ার তিনটি বাসায় গৃহস্থালিকাজ করেন। দুপুরের পর আবার বের হন। আরও তিনটি বাসায় কমপক্ষে ছয় ধরনের কাজ শেষ করে যখন বাসায় ফেরেন, ততক্ষণে অস্তমিত সূর্য।

মাসের ২৫ থেকে ২৮ দিনই এমন রুটিন মেনে চলে জীবন। সব মিলিয়ে মাসে নাজমার আয় হয় আট থেকে নয় হাজার টাকা। ঘরভাড়া এবং দুই সন্তানের চাহিদা এই টাকায় পূরণ হয়। আর খাওয়াদাওয়ায় ব্যয় হয় স্বামীর আয়। সংসারে যে খরচ হয়, তার সিংহভাগের জোগান দেন নাজমা।

কিন্তু নাজমার এই আয় অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে কতটুকু? সংসারে আয়ের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী সমান হলেও মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে নাজমার কাজের কী মূল্যায়ন?

নাজমার মতোই দেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত প্রায় ১৭ লাখ নারী।

শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের একটি বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত। গৃহকর্মে শ্রমের প্রায় ৯০ ভাগই নারীর। এই বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে এত দিনেও নিশ্চিত হয়নি অধিকার এবং কর্মপরিবেশ।

সরকারি পর্যায়ে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এখনও শেষ হয়নি নীতিমালা তৈরির কাজ। শুধু গৃহকর্মই নয়, সার্বিকভাবে নারীর গৃহস্থালিকাজের কোনো স্বীকৃতি নেই।

গৃহস্থালি কাজে বিপুল কর্মঘণ্টা ব্যয় করেও স্বীকৃতি পান না নারীরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৯০ শতাংশের ওপরে নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। আশির দশকে শ্রমবাজারে নারীর অবদান ছিল ৮ শতাংশ। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৩২ শতাংশ।

‘কিন্তু সার্বিকভাবে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়, পরিচালক, বড় ধরনের উচ্চপদে নারীর অবস্থান এখনও অনেক কম। এ জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধ, উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। পারিবারিক বা গৃহস্থালি শ্রমের কারণে নারীরা মূলধারায় আসতে পারে না। এ জন্য নারীর কাজের সহায়কপদ্ধতি, পলিসি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’

একটা স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট খুলে নারীর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমমূল্যের একটা আলাদা হিসাব করার প্রস্তাব দেন বিদিশা। তিনি বলেন, ‘এমন হিসাব করলে নারীর যে অবদান একেবারে আমাদের চোখের বাইরে থেকে যায়, সেটা বোঝা যাবে। এটা নারীর সম্মান বৃদ্ধিতে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

তিনি বলেন, ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলো শুধু স্বীকৃতি দিলে হবে না, পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন ঘরের কাজে সমভাবে অংশ নেয়, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক কাজের চাপের কারণে নারীরা মূলধারার শ্রমবাজারে কাজ করতে চায় না।

‘ইচ্ছা করলেও নারীরা অন্য কাজ করতে পারে না। এ জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তি খাতের অফিসে শিশু দিবাকেন্দ্র থাকা জরুরি। আর যেসব অফিসে শিশু দিবাকেন্দ্র আছে সেগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের তুলনায় শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশগ্রহণই বেশি। সংসারে সচ্ছলতার জন্য নিজের জমানো অল্প কিছু অর্থ নিয়েই গ্রামের অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত একজন নারী তার ব্যবসা শুরু করার সাহস দেখাচ্ছে। তাদের এ শ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না।’

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বড়সংখ্যক নারী

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন দেশের বিপুলসংখ্যক নারী। ছবি: সাইফুল ইসলাম

সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের শ্রমশক্তির বিশাল অংশ। মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশেরই স্থায়ী কাজ নেই। দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে মোট শ্রমশক্তির মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। এর মধ্যে নারীশ্রমিক রয়েছেন ১ কোটি ৭১ লাখ ২১ হাজার।

কর্মক্ষেত্রে নারী

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গৃহস্থালিকাজ নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার পথে বড় বাধা। শ্রমবাজারে যোগ না দেওয়া নারীর ৮১ দশমিক ১০ শতাংশই এর জন্য ঘরের কাজের চাপকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে একই কারণে শ্রমবাজারে প্রবেশে বাধা পাচ্ছেন ৮ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ। উপযুক্ত কাজ পেলে শ্রমবাজারে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন নারীর সংখ্যাও পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ।

উপযুক্ত কাজ পেলে শ্রমবাজারে পুুরুষের চেয়ে নারীর আগ্রহ বেশি বলে জানিয়েছে বিবিএস। ছবি: সাইফুল ইসলাম

জিডিপিতে গৃহস্থালিকাজ

গৃহস্থালিতে নারীর যে কাজ দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না, সেই শ্রমের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য কত? বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির এক গবেষণা বলছে, গৃহস্থালিকাজে দেশের নারীরা বছরে ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন, যার আর্থিক মূল্যমান ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এই আর্থিক মূল্য যোগ হলে জিডিপিতে নারীর অংশ বর্তমানের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।

শ্রম জরিপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৫-২৯ বছর বয়স্ক নারীর ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশের শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা প্রশিক্ষণ নেই। অর্থাৎ তারা ঘরের ভেতরে সাংসারিক কাজে নিয়োজিত। একই বয়সের পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। তাই শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং সার্বিক শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নিতে পারায় গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকার প্রবণতা বাড়ছে।

শ্রমশক্তিতে নারী

শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ ভাগের বেশি। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প, সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছে। তবে, এর মধ্যে মাত্র ৫৯ লাখ ৩ হাজার নারী অর্থের বিনিময়ে কাজ করছে। তাদের মাসিক আয় গড়ে ১২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকেরা জানান, শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও দৈনিক মজুরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

নারীর কর্ম খাত

দেশের নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ কাজ করেন কৃষি খাতে। ছবি: সাইফুল ইসলাম

কৃষি খাত এখনও নারীর শ্রম নিয়োজনের প্রধান জায়গা। নারীরা যেসব খাতে শ্রম দেয়, তার মধ্যে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে কৃষি। ৫ দশমিক ২ শতাংশ শিল্প খাতে এবং সেবা খাতে রয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। শিল্প খাতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে নারীশ্রমিক নিয়োগের সংখ্যা কমে গেছে। আশির দশকে গার্মেন্টস খাতে নারীশ্রমিকের হার ছিল প্রায় ৮০ ভাগ। তবে এখন তা নেই।

সিপিডির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, তৈরি পোশাক খাতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৬০ ভাগের বেশি না। নারীর বড় পদে না আসার কারণ দক্ষতার অভাব, পারিবারিক কাজের চাপ ও নিয়োগকর্তাদের মানসিকতা।

পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন হাফিজ নিউজবাংলাকে বলেন, একজন নারী সামনে এগিয়ে যেতে পারবে কি না, সে বিষয়ে পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তবে আগের চেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। নারীর নিজে কিছু করার ক্ষেত্রে অর্থায়ন সবচেয়ে বড় বাধা। নারীরা ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসার জন্যও যেন সহজে অর্থ পেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।

এ বিভাগের আরো খবর