স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ধাপ পার হলো। এখন চূড়ান্ত ধাপ অতিক্রমের পালা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে এসে এ দেশ জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত কাতারে পৌঁছাব। দ্বিতীয় ধাপের অর্জন অবশ্যই গর্বের বিষয়। অর্থনীতির জন্য একটা মাইলফলক।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না হলে ২০২৪ সালের মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে যেত বাংলাদেশ। মহামারির কারণে নানা ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়ায় সময় দুই বছর পিছিয়ে যায়।
উন্নয়নশীল দেশ হলে অনেক সুযোগসুবিধা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। এ জন্য ২০২৬ সালের আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন লাগবে, যাতে করোনার আগে উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেটাকে এগিয়ে নেয়া যায়। তাহলে রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
দক্ষ জনশক্তি লাগবে। কারণ, জনশক্তি দক্ষ হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। এর ফলে এলডিসি পরবর্তী বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।
এলডিসি উত্তরণের পর সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ আসবে বাণিজ্যে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে নানাভাবে সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন: ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধার কারণে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সুবিধাটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর আর থাকবে না।
তবে এটা ঠিক, উন্নয়নশীল দেশের ঘোষণা হলেই এ সুবিধা বন্ধ হবে না। ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হলেও পরের কয়েক বছরে এ সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ভালো হবে। ফলে বিদেশিরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, তারা বাংলাদেশেকে বেশি গুরুত্ব দেবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ নেয়া সহজ হবে।
এটা ঠিক, আমাদের ঋণ গ্রহণের সুদের হার বেশি। বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্বব্যাংকের মাপকাঠিতে কয়েক বছর আগেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, ফলে এরই মধ্যে কিছুটা উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। তা ছাড়া বিদেশ থেকে, বিভিন্ন সংস্থা থেকে, উন্নয়ন সহযোগী বা ডেভেলপমেন্ট পার্টনার থেকে যেসব ঋণ নেয়া হয়, সেখানে অনুদানের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি থাকে।
বাংলাদেশকে অবশ্যই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে সক্ষমতা বাড়ে।
ওষুধ খাতে একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ আমরা এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধ খাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত এলডিসির যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটা আর থাকবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যে লাইসেন্সও নিতে হবে।
আমাদের উচিত হবে এখন থেকেই উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের আগে বাণিজ্যসহ যেসব প্রস্তুতি দরকার, সেটা নেয়া। যেসব বাজারে বিশেষ সুবিধা আছে, সেই বাজারগুলো নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ সুবিধা পায় না বাংলাদেশ। কাজেই ইউরোপের বাজার নিয়ে ভাবতে হবে বেশি।
তৈরি পোশাক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। লিড টাইম (ক্রেতার কাছে পণ্য শিপমেন্টের সময়) কমাতে হবে।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে বেশি যেতে হবে। ভিয়েতনাম তাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে এটা করছে।
মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন যেন সকলের জন্য হয়। যারা ধনী, শুধু তাদের জন্য উন্নয়ন হলে চলবে না। সাধারণ মানুষের কাছেও যেন উন্নয়নশীল দেশের সুফল পৌঁছায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের কাছে যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক সুরক্ষার সুফল পৌঁছায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
শিক্ষার উন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া এবং দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা জরুরি। এসব সম্পন্ন করলে ২০২৬ সালে যখন উন্নয়নশীল দেশ হবে, তখন সত্যিকার অর্থে সর্বসাধারণের জন্য অর্থবহ হয়ে উঠবে।
এ জন্য এখন থেকে এসব প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা যদি প্রস্তুতি শুরু করি, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
ড. নাজনীন আহমেদ: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মৌসুমী ইসলাম