ব্যাংকে সুদের হার কমছেই, এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েই চলছে। মহামারিকালে নিশ্চিত মুনাফা হাতছাড়া করতে চাইছে না মানুষ।
চলতি অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল, বছরের সাত মাসেই তার চেয়ে ৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বেশি ঋণ হয়ে গেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ লক্ষ্য ধরা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই থেকে জানুয়ারি এই সাত মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
এই সাত মাসে মোট বিক্রি হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার। আর মানুষ ভেঙেছে ৩৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার।
আর সুদ হিসেবে সরকার পরিশোধ করেছে ১৮ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া ঋণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে তিন গুণেরও বেশি।
গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৭ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকার।
কোন মাসে কোন সঞ্চয়পত্র বিক্রি
গত সাত মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র যার অংক ১৩ হাজার ৬১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৭ কোটি ৮২ লাখ টাকার।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২৭৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।
আগস্টে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।
সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে হয় ৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
আর অক্টোবরে আগের মাসের তুলনায় কিছুটা কমে যায়। ওই মাসে বিক্রি হয় ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
নভেম্বরেও বিক্রির পরিমাণ কম হয় আগের মাসের তুলনায়। ওই মাসে বিক্রি হয় ৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরে আরও কমে হয় ১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। তবে জানুয়ারিতে বিক্রি হয় চলতি অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি যা ডিসেম্বরের সাড়ে তিন গুণের মতো।
সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ বেশি যে কারণে
ব্যাংকগুলোতে এখন সর্বোচ্চ সুদ হার ছয় শতাংশ। তবে ভল্ট উপচে পড়ার কারণে এখন টাকা নিতে খুব একটা আগ্রহী নয় ব্যাংক। বড় অংক আর দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় না হলে তিন থেকে চার শতাংশের বেশি সুদ দিতে চাইছে না তারা।
ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আরও বেশি লাভজনক হতে পারে। তবে সেখানে ঝুঁকিও ব্যাপক। এটিও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে চলার এক কারণ।
মূলত চার ধরনের সঞ্চয়পত্র সাধারণ মানুষ কেনে, যার সর্বনিম্ন সুদ হার ১১.০৪ শতাংশ, আর সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ।
একক মাস হিসেবে শুধু জানুয়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা।
অথচ গত বছরের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর দুই এক মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সঞ্চয়পত্র ভেঙেছিল মানুষ। কিন্তু জুলাই থেকেই পরিস্থিতি পালটে যায়।
সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ করতে চায় না। এ জন্য নানা কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। এ কারণে বিক্রি বেড়েই চলেছে, যদিও এটি বছর শেষে সরকারি কোষাগারে বাড়তি চাপ হিসেবে দেখা দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা রেখে এখন তেমন মুনাফা মিলছে না। সেক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র নিরাপদ। এই মাধ্যমে মুনাফা বেশি, পাশাপাশি অর্থের সুরক্ষাও নিশ্চিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ হলে, সরকারের সুদ দায় বাড়ে। কারণ এখানে সুদ ১০ ভাগের বেশি।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অন্য সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমে গেছে। আগে ব্যাংকে আমানত রাখলে ৭ বা ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেটা ৫ শতাংশে নেমে গেছে। এজন্য নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ ঝুঁকছে। এখানে ১১ বা তার চেয়ে বেশি সুদ দেয়া হয়।’
বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে চায় সরকার
বিপুল পরিমাণ সুদ দিতে হয় বলে সরকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে নানাভাবে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সুদ কমানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তবে নিজ দলের তীব্র আপত্তির মুখে সে প্রস্তাব থেকে সরে আসেন।
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় বহু নেতার বক্তব্য ছিল, অবসরে যাওয়া বা সাধারণ প্রান্তিক মানুষ যারা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারেন না, তারা টাকা রেখে মুনাফা দিয়ে সংসার চালান। তাদের জন্য সরকার বাড়তি সুদ দিলে সেটাকে সেবা হিসেবেই ধরা যায়।
এরপর বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সরকার বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এখন একক নামে ৫০ লাখ টাকা আর যৌথ নামে এক কোটি টাকার বেশি কেনা যাচ্ছে না।
আবার মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ব্যাংক হিসাব না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্তও আরোপ করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় কমেছে ব্যাংক ঋণ
চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি আর সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে।
এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংকমুখী হচ্ছে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে।
এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ করেনি সরকার। উলটো আগের নেওয়া ঋণের প্রায় ৩১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা শোধ করেছে।
এতে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অথচ এ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার।