সবচেয়ে বেশি দর বাড়া ছয়টি কোম্পানির চারটি লোকসানি। এর তিনটি গত ১০ বছরে কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি, সামনে দিতে পারবে এমন সম্ভাবনাও কম।
বিপুল পরিমাণ লোকসান, শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ঋণাত্মক, এই অবস্থাতেও কোম্পানিগুলোর দাম বেড়েছে এক দিনে যতটুকু বাড়া সম্ভব ততটুকুই।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিন আর সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনে এই ঘটনাটিই ঘটল।
মাসজুড়েই পুঁজিবাজার হতাশা ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছে। ক্রমাগত দরপতনের বৃত্ত ভেঙে গত সপ্তাহের শেষ দুই কার্যদিবসে প্রায় ১০০ পয়েন্ট সূচক পুনরুদ্ধার হওয়ায় সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে বাজারের আচরণের দিকে দৃষ্টি ছিল বিনিয়োগকারীদের।
তবে সপ্তাহের শুরুতেই আবার হতাশ হতে হলো তাদের। কমেছে বেশির ভাগ শেয়ারের দর। দর ধরে রাখতে পারছে না ভালো কোম্পানি। গতি নেই লেনদেনে। কিন্তু মন্দ শেয়ার হিসেবে পরিচিত দুর্বল কোম্পানির শেয়ারধারীদের পোয়াবারো।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে প্রায়ই কারসাজি হয়। যখন পুঁজিবাজারে টানা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়, তখনই এই ঘটনা ঘটে।
কী খবর আছে দুর্বল কোম্পানির
জিলবাংলা সুগার মিল, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জেড ক্যাটাগরির একটি কোম্পানি। ডিএসইর ওয়েবসাইটে এই কোম্পানির লভ্যাংশ দেয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু রোববার এই কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই কোম্পানির মূল্যসীমা অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি বাড়ার সুযোগ নেই। কিন্তু শতাংশের হিসাবে ১০-এর নিচেই থাকে সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধির হিসাবটি।
জিলা বাংলা সুগার মিলের খোঁজখবর দেয়ার জন্য দায়িত্বে থাকা কোম্পানি সচিব লাইলি আক্তারও অবাক হয়েছেন যখন জেনেছেন শেয়ারের দর বেড়েছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? কোম্পানি যেমন ছিল, এখন তেমনি আছে। কোনো অগ্রগতির খবর নেই।’
তিনি বলেন, ‘লোকসানে থাকায় লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু তারপরও কেন শেয়ারের দর এভাবে বাড়ছে তা জানা নেই।’
জেড ক্যাটাগরির আরেক কোম্পানি সাভার রিফ্যাক্টরিজ লিমিটেড। বিবিধ খাতে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটি ১৯৮৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও লভ্যাংশ দেয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তারপরও বিনিয়োগকারীদের পছন্দের তালিকায় থাকা এই কোম্পানির শেয়ার দরও রোববার বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এমন খবরে কোম্পানির সচিব বেলায়েত হোসেন খানও হতবাক হয়ে প্রশ্ন করেছেন, ‘আজও দাম বেড়েছে?’
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি আছেন যারা এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ান। আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না। তবে কোম্পানির কোনো অপ্রকাশিত তথ্য নেই যার কারণে শেয়ারের দর বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির আগের সমস্যাগুলো এখনও আছে। কাঁচামাল কিনতে না পারা, পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকা, চেষ্টা করা হচ্ছে ভালো কিছু করার। কিন্তু কতটুকু হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
রোববার জেড ক্যাটাগরির এই দুই কোম্পানি নয়, ছিল শ্যামপুর সুগার মিল, যার শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফ্যামিলিটেক্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৮ শতাংশ।
পতনের মধ্যেও কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। ছবি: নিউজবাংলা
বাজার বিশ্লেষকরা যা বলছেন
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের যেসব খবরাখবর আছে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই পুঁজিবাজারে। সূচক পড়ে যাওয়ার পেছনে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব অনেক বেশি। গত ডিসেম্বরের পর বিনিয়োগকারীরা যেভাবে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থাশীল হয়েছিল এখন ততটা নেই।
তিনি বলেন, ‘দুর্বল কোম্পানি নিয়ে কিছু বলার নেই। কিছু বিনিয়োগকারী আছেন যারা এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেন। কিছু দিন পর আবার এগুলোর দরপতন হয়। কিন্তু এটা সার্বিক পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতিকর। যারা স্বল্প সময়ে মুনাফা নিতে আগ্রহী তারা ভুলে এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারে। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।’
লেনদেনে বেক্সিমকো, রবি, বেট বাংলাদেশ
লেনদেনের শীর্ষে আবার ঘুরেফিরে বেক্সিমকো লিমিটেড, রবি আজিয়াটা ও বেট বাংলাদেশ-বিএটিবিসি।
বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১৩১ কোটি ৬১ লাখ টাকার। লেনদেন হয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫২ হাজার শেয়ার। কোম্পানির শেয়ার দর ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৮০ টাকা ৫০ পয়সা।
রবির ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৯ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। শেয়ার দর ৪৩ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩ টাকা ৯০ পয়সা।
বেট বাংলাদেশ- বিএটিবিসির ৩ লাখ ৩৭ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫২ কোটি টাকায়।
সবচেয়ে বেশি লেনদেনের তালিকায় ছিল সামিট পাওয়ার, লংকাবাংলা ফিন্যান্স, বেক্সিমকো ফার্মা, ওয়ালটন, জিবিবি পাওয়ারের শেয়ার।
খাতভিত্তিক লেনদেন
রোববার লেনদেন ব্যাংক খাতের ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ১৩টির। আর দর কমেছে ১১টির। পাল্টায়নি ছয়টির।
প্রকৌশল খাতেও বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর পাল্টায়নি। তালিকাভুক্ত ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর পাল্টায়নি ২০টির, দর বেড়েছে ৯টির। বাকি ১৩টির দর কমেছে।
ব্যাংকবহির্ভূত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ছয়টির। পাল্টায়নি চারটির। দর কমেছে ১৩টির।
বিমা খাতেও ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে সাতটির। দর পাল্টায়নি নয়টির। আর দর কমেছে ৩৩টির।
রাজধানীর একটি ব্রোকারেজ হাউসে উৎসুক বিনিয়োগকারীরা। ছবি: নিউজবাংলা
সূচক ও লেনদেন
ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১১ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪০৪ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ৩.০৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২২২ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৮ দশমিক ৯৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৬ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ৩৪৮টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১০২টির, কমেছে ১২০টির ও পাল্টায়নি ১২৬টির দর।
ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৬৬০ কোটি টাকা। আগের কার্যদিবসে মোট লেনদেন হয়েছিল ৭৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিএসইর লেনদেন কমেছে ৮৬ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে- সিএসই প্রধান সূচক সিএএসপিআই ৪৬ দশমিক ৮০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে।
লেনদনে হওয়া ২২৯টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৭৫টির, কমেছে ৮০টির, পাল্টায়নি ৭৪টির। সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।
আগ্রহ ও অনাগ্রহের কোম্পানি
রোববার ডিএসইতে দর বৃদ্ধির শীর্ষে ছিল আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, যার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
জিকিউ বলপেনের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
নতুন শেয়ার ই জেনারেশন লিমিটেডের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
এসোসিয়েট অক্সিজেনের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এছাড়া এ তালিকায় ছিল দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সোনালী আঁশ, বিডিল্যাম্প, ডোমিনেস স্টিল।
দর কমার শীর্ষে ছিল প্রাইম ফিন্যান্স, যার শেয়ার দর রোববার কমেছে ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
লংকাবাংলা ফিন্যান্সের শেয়ার দর কমেছে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
গোল্ডেনসন, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, মাইডাস ফিন্যান্সও ছিল সর্বাধিক দর বৃদ্ধির তালিকায়।