স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটে উন্নয়নশীল দেশের কাতারভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় মূল্যায়ন শেষে শুক্রবার রাতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সিডিপির সুপারিশের পর সবকিছু ঠিক থাকলে পাঁচ বছর পর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত হবে বাংলাদেশ।
প্রস্তুতি পর্বে বাংলাদেশের কী করা উচিত, চ্যালেঞ্জসমূহ কী- সব বিষয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অনন্য অর্জন। এতে আরও উজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি, এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে।
প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় জোর দিতে হবে: আহসান এইচ মনসুর
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এলডিসি থেকে আগেই বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হলো। আরও আগে স্বীকৃতি পেলে বেশি খুশি হতাম।’
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। তবে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। গরিব দেশগুলোকে সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।
‘অবশ্য এখন আর বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখে না দাতারা। ২০১৬ সাল থেকে মিশ্রিত দেশ (ব্লেনডেড) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নমনীয় ঋণ এবং কিছু ক্ষেত্র বাজারভিত্তিক ঋণ দেয় তারা।’
ঋণ পরিশোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যে ধরনের সক্ষমতা থাকা দরকার, বাংলাদেশের তা আছে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সস্তা ঋণ সুবিধা বাতিল হলেও তেমন অসুবিধা হবে না।
‘আমরা অত গরিব নই, যতটা ভাবা হয়। সক্ষমতা বাড়ছে। আরও বাড়াতে হবে। আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হতে পারে বাজার সুবিধা নিয়ে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। তখন বিশ্ব বাজারে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।’
তিনি বলেন, প্রস্তুতি পর্বে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় রয়েছে, তাই এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। সময় বাড়িয়ে প্রস্তুতি না নিয়ে ঘুমালে কোনো লাভ হবে না। শিল্পকারখানার দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।’
বিশ্বে বাংলাদেশের মার্যাদা বাড়াবে: ড. মোস্তাফিজুর রহমান
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পান্নত দেশ-এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের মার্যাদা বাড়াবে। দেশের ভাবমূর্তি ব্র্যান্ডিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের জন্যও এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
‘একই সঙ্গে বাংলাদেশে যারা বিনিয়োগ করতে চান বা বিদেশে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী তাদের কাছেও ইতিবাচক বার্তা যাবে।’
তবে উন্নয়নশীল দেশে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলেও মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজেটে যেসব খাতে ভর্তুকি সুবিধা দেয়া হয়, তা আর থাকবে না। কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় পণ্য রপ্তানির সুবিধা থাকবে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
‘বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্ব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। দেশীয় পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এত দিন যে প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে নতুন প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনেক চ্যালেঞ্জ সামাল দেয়া যাবে।
এ অর্জন স্বাধীনতা-উত্তর অর্থনীতির বড় মাইলফলক: গোলাম মোয়াজ্জেম
এলডিসি থেকে উত্তরণকে দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাইলফলক বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘এত দিন বাংলাদেশকে উদীয়মান ও বিকাশমান শক্তি হিসেবে আকার-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে। এবার সেটার বাস্তব প্রতিফলন ঘটল।’
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কৃষি, সেবা, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সে অগ্রগতি- সব মিলিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের ঘোষণার মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘উত্তরণের ফলে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শক্তিশালী অবস্থান রাখার সুযোগ অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। সে কারণে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, রপ্তানি, সেবা খাতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা গেছে।
‘প্রস্তুতি পর্বে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানি ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ওষুধ খাতের পেটেন্ট সুবিধা যাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে সে বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।’
নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে: শামস মাহমুদ
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকগুলো উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।’
এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেকগুলো সমস্যা তৈরি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’
শামস মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে, কিন্তু গত তিন বছর ধরে একটা পণ্যের যে দর থাকে সেটা কমছে। এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে যেসব ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যেত সেগুলো আর থাকবে না।’
রাজস্ব বিভাগে সংস্কারে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘তা না হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে না। সরকার যেসব বিনয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।’