মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় বাড়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেশিন বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল দুই বছর আগে। ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি নামে এই মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের উদ্যোগ নেয় সরকার।
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নানা উদ্যোগ নিলেও দুই বছরে তেমন অগ্রগতি নেই।
এ পরিকল্পনার আওতায় সারা দেশের যোগ্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইএফডি-এর আওতায় আনার কথা বলা হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে ২০ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এর ৮০ শতাংশই ছোট ও মাঝারি।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত মাত্র এক হাজার তিনশ প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানো হয়েছে। এ হিসাবে এক শতাংশের কম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর আওতায় এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাট বিভাগকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ইএফডি ব্যবস্থা চালু করা হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। পর্যায়ক্রমে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এর আওতায় আনা হবে।’
এনবিআর বলেছে, এ বছরের জুনের মধ্যে ১০ হাজার মেশিন বসানো হবে। আরও এক লাখ মেশিন আমদানির জন্য এরই মধ্যে দরপত্র ডাকা হয়েছে।
ইএফডি হচ্ছে আধুনিক হিসাবযন্ত্র। এটি ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার বা ইসিআরের উন্নত সংস্করণ।
ইএফডির মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের লেনদেনের প্রকৃত তথ্য জানতে পারেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। এ জন্য রাজস্ব বোর্ডে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সার্ভার বসানো হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের প্রধান উৎস ভ্যাটের বড় একটি খাত হচ্ছে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসা। কিন্তু এ খাতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি হয়। মোট ভ্যাট আদায়ের মাত্র তিন শতাংশ এখান থেকে আসে।
গত বছরে করা এনবিআরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসাখাতে বছরে যে পরিমাণ লেনদেন হয়, তা মোট দেশজ উপাদন বা জিডিপির ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ এ খাতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা থেকে নামমাত্র ভ্যাট আহরণ হয়। বর্তমানে বছরে মোট ভ্যাট আদায় হয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা আসে খুচরা-পাইকারি খাত থেকে।
রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিকমতো আদায় করতে পারলে এখান থেকে বছরে বর্তমানের চেয়ে পাঁচ গুণ ভ্যাট আদায় করা সম্ভব।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, জিডিপিতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার যে অবদান, তার তুলনায় খুব কমই ভ্যাট আহরণ হয়। এ খাতে বেশি নজর দিলে আদায় বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বাড়বে।
ইলকেট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) চালু করে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় ভ্যাট আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে। কিন্তু ওই ব্যবস্থা নানা ধরনের ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে ব্যর্থ হয়।
৯ বছর পর ২০১৮ সালে ইসিআরের উন্নত সংস্করণ ইএফডি চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন এক বছেরর মধ্যে সারা দেশে ইএফডি বসানোর কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক।
২০২০ সালের আগস্টে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি ইএফডি মেশিন চালু করে এনবিআর। করোনার কারণে এর কার্যক্রম পিছিয়ে যায় বলে জানান রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।
যে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি, সে সব প্রতিষ্ঠানে এই মেশিন বসানো হয়। ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে এক হাজার দুইশ মেশিন বসানো হয়।
শুল্কমুক্তভাবে চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি মেশিনের দাম পড়েছে ২২ হাজার টাকা। প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে এসব মেশিন দেয়া হলেও এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতেও বিনামূল্যে দেয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে।
এসব মেশিন আনার জন্য চীনের ‘এসজেডজেডটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে ঠিকদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। মেশিন ইনস্টলেশনের বিষয়ে কারিগরী সহায়তাও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে গত বছর এক আদেশ জারি করে এনবিআর। তাতে হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, পোশাক বিপণী, শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সুপরাশপ, ফার্নিচারের দোকান, জুয়েলারির দোকানসহ ২৫ খাতে এই মেশিন ব্যবহারের কথা বলা হয়।
ইএফডি মেশিন ব্যবহার করে ভ্যাট পরিশোধের জন্য লটারিতে পুরস্কার ঘোষণাসহ এনবিআরের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত ফল আসছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ইএফডি ছাড়াই ভ্যাট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি ও সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেন, করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি দোকানদাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা এদের কাছ থেকে জোর করে ভ্যাট আদায় করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ইএফডির বিরোধিতা করছি না। কিন্তু তাই বলে ভ্যাট আদায়ের নামে হয়রানি করা উচিত নয়।’