রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ভারতে সহস্রাধিক আইটেমের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এসবের মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঁচা পাট, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য ও বাইসাইকেল।
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, এসব পণ্য ভারত নিজেই উৎপাদন করে এবং অন্য দেশে রপ্তানিও করে।
এই অভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বা সমজাতীয় পণ্যের রপ্তানির কারণে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কম। এ সুযোগে সে দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি পণ্যের মূল্য নিয়ে দরকষাকষি করতে পারেন। এতে রপ্তানিকারকের নিট লাভ খুব বেশি থাকে না।
অন্যদিকে প্রতিবেশি দেশের ভোক্তারাও বাংলাদেশের পণ্যকে ততটা কদর করতে চান না। কারণ ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি হওয়ায় সংস্কৃতি ও আচারের মিলের কারণে বাংলাদেশি পণ্যে তারা নতুনত্ব খুঁজে পান না। এসব বিবেচনায় আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ব্যবসায়ীরা এবং ভোগ-ক্রয়ে দেশটির বেশির ভাগ ভোক্তা এড়িয়ে চলেন বাংলাদেশি পণ্য। উদ্ভাবন, রুচিবোধ, টেকসই, সুদৃশ্য মোড়ক বা আভিজাত্যের প্রতিফলনে তারা প্রাধান্য দিচ্ছেন অন্য দেশের পণ্যকে।
এর প্রমাণ মেলে ভারতের বৈশ্বিক আমদানি পর্যালোচনা থেকে।
২০১৮-১৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতের মোট আমদানি পরিমাণ ছিল ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১৯-২০ সালে শুধু শীর্ষ দশ দেশ থেকেই এই আমদনির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬১ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অর্থাৎ ভারত বিশ্ববাজার থেকে অনেক পণ্য কিনছে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নয়। আবার একই ধরনের পণ্য বিশ্ববাজারে পাঠালেও বাংলাদেশ তা ভারতে পাঠাচ্ছে না। যদিও একক দেশ হিসেবে শুধু ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ১০ শতাংশ লেনদেন সারছে। এতে আট গুণ বেশি পণ্য বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করলেও সে তুলনায় ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানি করছে তার মাত্র এক শতাংশ।
এর কারণ, ভারত সরকার সেদেশের পরিস্থিতি ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। প্রাধান্য দেয় সেখানকার ব্যবসায়ীদের দাবিকে। ফলে স্থানীয় শিল্প-ব্যবসাকে সুরক্ষা দিতে কখনও বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি (সিভিডি) আরোপ করছে, কখনও বা বিশেষ কোনো পণ্যে বসাচ্ছে আ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি।
এক সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর ভারত কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি (সিভিডি) আরোপ করেছিল। ২০১৪ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়। এখন পাটজাত পণ্যে ধার্য করা হয়েছে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি। ফলে ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে ইন্দোবাংলা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা নেই। সেখানে বাড়তি শুল্ক দিয়ে পণ্য পাঠানো সত্ত্বেও প্রতিবছর আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। অথচ ভারতের বাজারে আমরা প্রায় শতভাগ শুল্ক সুবিধা পেয়েও পোশাক রপ্তানি একটা কাউন্টেবল জায়গায় নিতে পারছি না। উল্টো কমানো হচ্ছে পোশাকের দাম। বুঝতে হবে সেখানে চাহিদা সৃষ্টিতে কোথায় আমাদের দুর্বলতা। শুধু পোশাক নয়, সব রপ্তানি পণ্যেরই একই অবস্থা। আর অশুল্ক বাধার কথা নাই-ই বললাম।’
বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পুরোপুরি ভারতের অনুকূলে। তবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩৭ গুণ। কিন্তু তাতেও ঘাটতি কমেনি।
ভারত থেকে আমদানি পণ্যের তুলনায় দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন অফিসের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে মোট ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য। একই সময়ে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪৫ কোটি ২৯ হাজার ডলারের এবং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল ৬৮ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ ডলারের।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ভারতের স্পর্শকাতর পণ্যতালিকা ৪৮০টি থেকে কমিয়ে মাত্র ২৫টিতে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়েই কার্যত বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে প্রায় শতভাগ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা প্রদান করা হয়। প্রতিবেশি হওয়ায় বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় এখানে কম খরচে পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। স্বাভাবিক নিয়মেই এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক সুবিধায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার কথা।
এই সম্ভাবনা দেখে ২০১৮ সালের এক প্রাক্কলনে বিশ্বব্যাংকও দাবি করেছে, বাণিজ্য সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো গেলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সীমা ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে তা বাড়ছে না, উল্টো আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রপ্তানির গতি ও চাহিদা প্রত্যাশিত হারে না বাড়াসহ নানারকম অশুল্ক বাধার বেড়াজালে এখনও দুই দেশের বাণিজ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও ৯ বিলিয়ন ডলারের বৃত্ত অতিক্রম করতে পারছে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্য, স্থান ও কালভেদে অশুল্ক বাধার ধরন বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেকই সম্পন্ন হয় স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় নো ম্যানস ল্যান্ডে পণ্য খালাস ও উত্তোলন করতে হয়। এতে একদিকে বিলম্ব ঘটে, অন্যদিকে পণ্যের দাম চড়ে। আবার মিউচ্যুয়াল রিকগনিশন অ্যাগ্রিমেন্ট না থাকায় দূরবর্তী টেস্টিং সেন্টার থেকে পরীক্ষণ-সমীক্ষণের ফলাফল না আসা পর্যন্ত পণ্য বন্দরেই পড়ে থাকে। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে পারছে না পরিবহন, বিনিয়োগ ও লজিস্টিকস কানেক্টিভিটির উন্নতি না হওয়ার কারণে। সেখানে অনেক ঘাটতি আছে। ফলে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা সত্বেও ঢাকা-দিল্লি পণ্য পরিবহন খরচ ঢাকা থেকে ইউরোপীয় বা মার্কিন বন্দরে পরিবহন খরচের চেয়ে অনেক বেশি।’
ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা তৈরির তাগিদের কথা বলছেন ইন্দোবাংলা চেম্বারের সভাপতি মাতলুব আহমাদ।
ইন্দোবাংলা চেম্বারের সভাপতি মাতলুব আহমাদ দাবি করেন, ‘ভারতে রপ্তানি আশানুরূপ বাড়বে না, যদি আমরা ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা তৈরি করতে না পারি। তা করতে হলে সবার আগে দরকার গতানুগতিক বা সমজাতীয় পণ্যের রপ্তানির ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নতুন ও বৈচিত্র্যময় পণ্য সেখানে নিয়ে যাওয়া।’
তিনি দাবি করেন, পণ্যভিত্তিক বাজারের সঠিক পর্যালোচনারও দরকার হবে। যার মাধ্যমে চাহিদা আছে এমন পণ্য রপ্তানির জন্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এতে স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে বাজার। কিন্তু এর জন্য নিজেদেরও কিছু কাজ করতে হবে। রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা, উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও গুণগত মান বাড়ানোতেও নজর থাকা জরুরি। এতে রপ্তানি পণ্যের ন্যায্য দামও মিলবে।
বিদ্যমান এই বাজার পরিস্থিতিকে অবশ্য সরকার সম্ভানার চোখেই দেখছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রপ্তানি কম হয় বলেই ভারত বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার বাজার। এক সময় ভারতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা প্রাপ্তির সমস্যা ছিল। এখন সেটা নেই। কিছু অশুল্ক বাধা আছে। এগুলো দূর করতে কাজ করছে সরকার। ইতিমধ্যে কতগুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর কিছু কাজ শেষ হয়েছে, বাকিগুলোরও চলছে। ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন এবং দুই কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অবকাঠামো উন্নত করা হচ্ছে। কমানো হচ্ছে নথিকরণের ঝামেলাও।’
বাংলাদেশ-ভারতের অধিকাংশ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে বেনাপোল স্থলবন্দর নিয়ে। ছবি: নিউজবাংলা
অনিষ্পন্ন ইস্যুর সমাধান প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পাটজাত পণ্যের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারে গভীরভাবে কাজ করছে সরকার। এর বাইরে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যে পরিবহণ খরচ কমিয়ে আনতেও রয়েছে নতুন উদ্যোগ। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটর ভেহিকল (বিবিআইএন) চুক্তিকে কার্যকরের চেষ্টা করছে সরকার। এক্ষেত্রে ভুটান না থাকলে বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের সঙ্গে বিআইএন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।’
পণ্যে নতুনত্ব ও সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘রপ্তানি বহুমুখীকরণে কার্যকর অনেক উদ্যোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে নীতি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে, তার সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল পাবে দেশ, যা ভারতেও বাজার চাহিদা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এর মাধ্যমেই আমরা ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবো।’