মাঝে মুঠোফোনের জৌলুসে হাতঘড়ির ঐতিহ্যের আবেদন খানিকটা হলেও কমে এসেছিল। চলতি ফ্যাশনের ধারায় হাতঘড়ির সেই আবেদন আবার ফিরে এলেও চলমান করোনাভাইরাস মহামারি মন্দাবস্থা তৈরি করেছে পাটুয়াটুলীর পাইকারি ঘড়ির বাজারে।
পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী হাতঘড়ি ও দেয়ালঘড়ির বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার। সড়কের দুই পাশে গড়ে ওঠা চারটি ঘড়ির মার্কেটে অন্তত সাড়ে ৩০০ দোকান আছে। মূলত এখান থেকে সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারা ঘড়ি কিনে নিয়ে যান।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটা মূলত আমদানিনির্ভর খাত। প্রতি বছর যে পরিমাণ হাতঘড়ি আমদানি করা হয়, তার অন্তত ৯০ শতাংশ আসে চীন থেকে। নিত্যনতুন ডিজাইন ও তুলনামূলক কম দামই এর মূল কারণ। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় এক বছর হাতঘড়ি আমদানি বন্ধ। পাশাপাশি বিক্রিও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে অনেকে এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এমন অবস্থায় এই খাতের স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার আকুতি জানিয়েছে বাংলাদেশ ঘড়ি ব্যবসায়ী সমিতি।
পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ঘড়ির বাজার। ছবি: নিউজবাংলাসমিতির হিসাবে সারা দেশে ছোট-বড় প্রায় ৭ হাজার ঘড়ি ব্যবসায়ী আছেন। এর মধ্যে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০-এর মতো। আর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শতাধিক।
বৃহস্পতিবার পাটুয়াটুলীর আজিজুর রহিম মার্কেটে ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ে সংগঠনটির সহসভাপতি এ কে এম সামিউল কবির নিউজবাংলাকে বলেন, মোবাইলের যুগে সময় দেখার জন্য ঘড়ির প্রয়োজন কমলেও এই যন্ত্রের চাহিদা এখনো কমেনি। কারণ, শুধু সময় জানতে নয়, হাতের ঘড়িটি একজন মানুষের ব্যক্তিত্বও প্রকাশ করে থাকে। এ ছাড়া উপহার হিসেবেও এটা দারুণ। ফলে বাজার ভালোই যাচ্ছিল।
সামিউল কবিরের ভাষ্য, করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে প্রতি মাসে পাটুয়াটুলীর ব্যবসায়ীরা অন্তত ৫০ লাখ টাকার ঘড়ি আমদানি করতেন। এখন তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে।
বেচাকেনা না থাকায় দোকানে অলস সময় কাটছে ঘড়ি ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের। ছবি: নিউজবাংলাসমিতির পরিচালক এস এম মোস্তাফিজুর রহমান ‘এস কে ট্রেডিং’ নামে একটা ঘড়ির দোকানের মালিক। তিনি বলেন, এই খাতের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী এখন পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকের দোকানভাড়া মেটানোর সক্ষমতাও নেই।
সমিতির নেতাদের এমন ভাষ্যের সত্যতা মেলে ‘রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটের’ ঘড়ি ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেন, দেখা যায় কোনো কোনো দিন একটা ঘড়িও বিক্রি হয়নি।
ঘড়ির আরেকটি পরিচিত বাজার বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার আগে দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার ঘড়ি বিক্রি হতো। এখন ২ হাজার টাকা বিক্রি হলেও বেশি মনে হয়।
হাতঘড়ি-দেয়ালঘড়ি সমানে সমান
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতাদের কাছে হাতখড়ি ও দেয়ালঘড়ির চাহিদা সমান। চীন থেকে মুভমেন্ট যন্ত্র আমদানি করে দেশেই দেয়ালঘড়ি তৈরি করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তারাই দেশে দেয়ালঘড়ির চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ করছে।
হাতঘড়ির মতোই চাহিদা দেয়ালঘড়ির। ছবি: নিউজবাংলাএ বিষয়ে ঘড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি সামিউল কবির বলেন, দেশে তৈরি দেয়ালঘড়ি রপ্তানি করতে গেলে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ জন্য অল্প কিছু পণ্য রপ্তানি হলেও পরিসর বাড়াতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
পাটুয়াটুলী ও বায়তুল মোকাররম মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল না থাকায় দেশে হাতঘড়ি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকারের সহযোগিতা পেলে যন্ত্রাংশ আমদানি করে দেশেই সংযোজন করে বৃহৎ পরিসরে দেয়ালঘড়ি তৈরি করা সম্ভব। এতে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
বায়তুল মোকাররম মার্কেটে ১৯৮৮ সাল থেকে চালু আছে ‘খান ফ্যাশন ওয়াচ’। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নজরুল ইসলাম খান বলেন, মোবাইলের রমরমার এই যুগে ঘড়ির আবেদন এখনো ফুরায়নি। ঘড়ির প্রযুক্তিতে রূপান্তর ঘটেছে। অ্যানালগের বদলে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সার্কিট। এ ছাড়া যুগের সঙ্গে ঘড়িও প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়েছে। নকশাতেও এসেছে পরিবর্তন। তাই ঘড়ির ঐতিহ্যের যে আবেদন, তা এখনো রয়ে গেছে।