বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রবৃদ্ধি নয়, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বেশি জরুরি: ড. সেলিম

  •    
  • ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৮:৩৮

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান। প্রবৃদ্ধির বির্তকে না গিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বেশি নজর এবং মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করছেন, শুধু রপ্তানি খাতের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব, দারিদ্র্য পরিস্থিতি, আয়-বৈষম্যসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু কাওসার।

বর্তমান অর্থনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। এই অভিঘাত অপ্রত্যাশিত। অর্থনীতিতে এমন সংকট আগে কখনও দেখা যায়নি। অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার কারণে কঠিন সময় পার হয়েছে, তবু সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

লকডাউন দেয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে অবস্থার কিছুটা পুনরুদ্ধার হলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পখাতের দিকে যথাযথ নজর দেয়া গেলে সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ সম্ভব যাবে।

করোনার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। একে কীভাবে দেখছেন?

সংকটকালীন অর্থনীতির জন্য অবশ্যই এটা ভালো খবর। তবে রপ্তানির জন্য রিজার্ভ বাড়েনি, বরং করোনায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে রপ্তানি খাতে। বৈধ চ্যানেল এবং সরকারের দুই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়ায় রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির এটি অন্যতম কারণ।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমদানি কমে গেছে। এর সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। আমদানি কমায় ডলারের চাহিদাও কমেছে। ফলে রিজার্ভ বাড়ার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে।

চলতি অর্থবছরের অর্ধেকের বেশি পার হয়েছে, আগামীতে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?

অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজন বিবেচনায় তিনটি বড় খাত হলো দারিদ্র্য, অসাম্য ও শ্রমবাজার। করোনা এই তিনটি খাতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবে অনেকেই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। পাশাপাশি অসাম্য বেড়েছে।

অসংখ্য গরিব পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এখন প্রধান কাজ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা।

করোনা সংকটে তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। ছবি: নিউজবাংলা

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ কি পর্যাপ্ত?

এটা অবশ্যই সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। প্রণোদনার সুফল মিলেছে, ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে।

তবে প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিছু খাতে, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে সুবিধা বেশি পেলেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প বা এসএমই খাতে হতাশাজনক চিত্র দেখা যায়। এই প্যাকেজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি আরও বাড়বে।

আগামী অর্থবছরের (২০২১‌-২০২২) বাজেটে কোন খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত?

জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে দুটি বড় খাত হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। গত দুই দশক ধরে এ দুটি খাতের শক্তিশালী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে করোনার প্রভাব বেড়েছে। ফলে বৈশ্বিক পরিসরে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় রপ্তানি খাতের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে অর্থনীতি পনুরুদ্ধার সম্ভব নয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে রপ্তানি খাতের পাশাপাশি দেশীয় শিল্পে আরও বেশি সুরক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সে অনুযায়ী নীতি ও সহায়তা প্রদান করতে হবে।

রাজস্ব আহরণের অবস্থা ভালো নয়, করোনাকালে আরও খারাপ হয়েছে। রাজস্ব আদায় কম হলে সরকারের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে। ফলে রাজস্ব খাতে কার্যকর সংস্কারের পদক্ষেপ থাকতে হবে আগামী বাজেটে।

কোন ধরনের সংস্কার করলে অর্থনীতির গতি আরও বাড়বে?

কর ও ভ্যাটে বাস্তবমুখী ও কার্যকর সংস্কার করতে হবে। আর্থিক খাতে নজর দিতে হবে। সংকটের সময়ে সংস্কারের বড় ধরনের সুযোগ থাকে। চাইলে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে সরকার। সংস্কারের বিষয়ে সরকারের নির্দিষ্ট কমিটমেন্ট থাকাতে হবে বাজেট।

ব্যাংক খাতে কমিশন গঠন নিয়ে কথা উঠেছিল। উদ্যাগ নেয়া হলেও পরে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হলে কমিশন গঠন জরুরি।

করোনায় দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে বলে বেসরকারি জরিপে উঠে এসেছে। ছবি: নিউজবাংলা

সানেমের সাম্প্রতিক জরিপে দেশে দারিদ্র্যহার দ্বিগুণ বাড়ার তথ্য গ্রহণ করেনি সরকার। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

করোনাকালে দেশে দারিদ্র্য বাড়লেও এ বিষয়ে কোনো জরিপ হয়নি। কতটা দারিদ্র্য বেড়েছে, এর সমাধানে কোন ধরনের নীতি সহায়তা নেয়া প্রয়োজন, সে বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেশব্যাপী জরিপ করেছে সানেম। তথ্য উপাত্তের বিষয়ে যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এটাকে প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয়। প্রকৃত চিত্রের জন্য বরং আরও ব্যাপকভিত্তিক জরিপের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চাইলে এটা করতে পারে। এখনও সময় আছে।

কোন পদ্ধতিতে এই জরিপ করা হয়েছে?

দেশব্যাপী প্রায় ছয় হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষের মতামত নেয়া হয়। সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহে সীমাবদ্ধতা ছিল। ঝুঁকি এড়াতে টেলিফোনে মতামত নেয়া হয়। ছয় হাজার খানা জরিপ কিন্তু কম সংখ্যা নয়। আমাদের উদ্যোগগুলো অবাস্তব নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, এতে কোনো ধরনের ভুল নেই।

গরিব ও ধনীর মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েছে বলে জরিপের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ কী?

নতুন করে যারা গরিব হয়েছেন তারা নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। করোনা সেই সব কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। শহরের বিভিন্ন হোটেল–রেস্তরাঁসহ ছোট ছোট কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবিকা নির্বাহে অনেকেই নানান কাজ করছিলেন, করোনার কারণে হঠাৎ করে কাজ চলে যায়। এতে বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগার।

ক্ষেত্রবিশেষে ধনীদেরও ক্ষতি হয়েছে, তবে গরিবের তুলনায় কম। অর্থাৎ ধনীদের আয় অতটা কমেনি, যতটা কমেছে গরিবের। সামগ্রিকভাবে করোনাকালে আয়–বৈষম্য বেড়েছে।

প্রবৃদ্ধি বাড়লেও জনগণ কী সুফল পাচ্ছে?

উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেই এর সুফল পাওয়া যাবে তা ঠিক না। প্রবৃদ্ধি হতে হবে ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক)। গত কয়েক বছর ধরে শ্রম বাজারের ওপরে যে তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস তাতে দেখা গেছে, জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও কমেছে কর্মসংস্থান।

কর্মসংস্থান না হলে প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না। মুষ্ঠিমেয় বেশি সুবিধা পাবে। তাই, প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে কর্মসংস্থানের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেসব খাতে কাজের সম্ভাবনা সেসব খাতে বেশি করে নীতি-সহায়তা দিতে হবে। ফলে মানুষের আয়-রোজগারের সুযোগ আরও বাড়বে।

বর্তমান সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। এতগুলো হয়তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তবে আগামী কয়েক বছরে মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। পাশাপাশি ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ, এসব খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কর্মসংস্থান না বাড়লে প্রবৃদ্ধির সুফল পাবে না সাধারণ মানুষ

বৈষম্য বাড়ার কারণ কী?

উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্যের সম্পর্ক আছে। যেসব দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে সেসব দেশেও বৈষম্য বাড়ছে। এর একটা কারণ হতে পারে নীতি প্রণয়নে অসঙ্গতি।

বাংলাদেশে কর নীতিতে সমস্যা আছে। ধনীদের ওপর কর আরোপের বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। পাশাপাশি গরিবের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ও তাদের কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। শহরের লোক যেভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধা পাচ্ছে, গ্রামে সে ভাবে পাচ্ছে না। এসব বিষয়ে নজর না দিলে বৈষম্য কমবে না।

চলতি অর্থবছরে জিডিপি কত হতে পারে?

এটা বলা কঠিন। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়েছে। মতভেদ আছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে।

প্রবৃদ্ধির হার কত হলো সে বিষয়ে বিতর্ক না করে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায়। এ জন্য সঠিক নীতি ও কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা ও এসএমই খাত পুনরুদ্ধারের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে ক্ষেত্র প্রবৃদ্ধি কম হলেও তা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। প্রবৃদ্ধির হারের দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি ত্বরান্বিত করাই হচ্ছে বেশি জরুরি।

অর্থনীতি আগের চেহারায় ফিরতে কত সময় অপেক্ষা করতে হবে?

সংকট এখনও আছে। কারণ, করোনা বিদায় নেয়নি, নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর নতুন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। ফলে চ্যালেঞ্জ থাকবেই। পৃথিবীর সব মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে আরও সময় লাগবে।

সহসাই এখান থেকে মুক্তি মিলবে না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা। বাজেট এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাইরে কমপক্ষে দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে, যেখানে থাকবে সংকট মোকাবিলার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। অর্থনীতির আগের চেহারায় ফিরে আসতে আরও দুই বছর লাগবে।

এ বিভাগের আরো খবর