ফিরোজা বেগম। বড় হয়েছেন পটুয়াখালী জেলার একটি গ্রামে। নিজের পাশাপাশি পরিবারকে দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচাতে ১৪ বছর আগে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। কাজ করতেন এক চিকিৎসকের বাড়িতে।
এক বছর আগে ফিরোজার মাসিক বেতন ছিল ২২ হাজার টাকা। বেতনের প্রায় পুরোটাই স্বামী আর নিজ বাড়িতে বাবা-মাকে পাঠাতেন। ফিরোজার পাঠানো টাকা দিয়ে সংসার খরচের পাশাপাশি ঘর মেরামত, জমি কেনা ও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতেন তারা।
গত বছর করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর ফিরোজাকে বেতন দেয়া বন্ধ করে তার নিয়োগকর্তা। টানা ছয় মাস তাকে বেতন দেয়া হয়নি।
উপায়ান্তর না দেখে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন ৪০ বছর বয়সী ফিরোজা। ১৪ বছরে যে কয়টা টাকা জমাতে পেরেছিলেন, তার পুরোটাই নিয়োগকর্তার হাত থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে খরচ হয়ে যায় তার।
ফিরোজা ভেবেছিলেন ১৪ বছর পর দেশে ফেরার পর জীবনসংগ্রামে স্বামীকে পাশে পাবেন। কিন্তু তা হয়নি।
স্ত্রী খালি হাতে ফিরেছে জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন ফিরোজার স্বামী। এক যুগের বেশি সময় সংসার খরচে বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও শূন্য হাতে ফেরা স্ত্রীকে ঘরে ঠাঁই দেননি তিনি। বাপের বাড়িতে ফিরোজাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে মা ও দুই প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে দিন কাটছে ফিরোজার।
ফিরোজা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘এখন কোনো উপার্জন নেই। পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলছি। প্রায় দেড় লাখের মতো দেনা হয়েছে। এত টাকা কীভাবে শোধ করব, জানি না।’
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশিরা। দেশে পাঠানো কষ্টার্জিত টাকায় মেটে তাদের পরিবারের খরচ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
দেশে পাঠানো টাকায় দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে পারেন প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা। এতে গ্রামাঞ্চলে কমে দারিদ্র্যের হার।
করোনার আগে প্রতিবছর ১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের রেমিট্যান্স আসত বাংলাদেশে। করোনার আঘাতে বৈশ্বিক অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ায় বিভিন্ন দেশে কর্মরত হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
দারিদ্র্য থেকে পালাতে তারা বিদেশ গিয়েছিলেন। কিন্তু করোনা তাদের সেই আগের অবস্থানেই এনে দাঁড় করিয়েছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে রেমিট্যান্স এক দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ছিল।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে বলা হয়, ২০০৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা কমে অর্ধেক অর্থাৎ ২০.৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু করোনা মহামারিতে দেশের বাইরে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের জুনে এই হার বেড়ে ২৯.৫ শতাংশে ঠেকেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বৈশ্বিকভাবে বাড়তি ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের শুরু থেকে চার লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফেরত এসেছেন। ভবিষ্যতে কী করবেন, তা তাদের জানা নেই।