দেশে দ্রুত শিল্পায়নের জন্য গতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী। তিনি বলছেন, এ জন্য ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হতে হবে।পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব-আইপিওতে ভালো কোম্পানি ও সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএসই পরিচালক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন সুমন।
পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
সূচক ও লেনদেন বাড়ছে। দীর্ঘ সময় ধরে পতনের ধারা ছিল পুঁজিবাজারে, এখন সে জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা ইতিবাচক।শেয়ারবাজারে গতি আসার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানো, কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া, কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের এককভাবে দুই শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ ক্রয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উদ্যোগ গ্রহণ, সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনকারী কোম্পানিগুলোকে বিএসইসিতে ডেকে কাউন্সেলিং করা। এসব পদক্ষেপের ফলে চাঙা হচ্ছে পুঁজিবাজার।আগে নিয়ম ছিল, বিনিয়োগকারী চাইলে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে আবেদন করতে পারত। সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়াগে বাধ্যবাধকতা ছিল না। নতুন নিয়মে, আইপিওতে আবেদন করতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে। এর ফলে সেকেন্ডারি মার্কেটেও বিনিয়োগের সুযোগ আরও অবারিত হয়েছে। বিএসইসির এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী, এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
বর্তমানে পুঁজিবাজারে অনেক কোম্পানি আছে যেগুলোতে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কম। বিনিয়োগকারীদের সেসব কোম্পানির সন্ধান করতে হবে। এখন প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। অনেক কোম্পানি লভ্যাংশও ভালো দিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারী যদি লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য শেয়ার ধরে রাখে তাতেও ক্ষতি নেই। এ ছাড়া প্রতিদিনের লেনদেনেও মুনাফার সুযোগ রয়েছে।
যত ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে পুঁজিবাজারের গ্রহণযোগ্যতা ততই বাড়বে। লেনদেন ও মূলধন যত বাড়বে ততই নতুন বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিতে হলে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে?
বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বিনিয়োগকারীদের হতাশা কাটাতে হবে। বিনিয়োগকারীরা লাভবান হলে বাজার আরও বড় হবে। নতুন বিনিয়োগকারী আসবে।
শিল্পায়নে মূল মাধ্যম হচ্ছে পুঁজিবাজার। ফলে এই বাজারকে শক্তিশালী করতেই হবে। এ জন্য ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ হতে হবে তালিকাভুক্ত কোম্পানির। কারণ, এ প্রতিবেদন দেখে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। আর্থিক প্রতিবেদন যত স্বচ্ছ হবে পুঁজিবাজারও তত শক্তিশালী হবে।
বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে কী করা উচিত?
আমাদের বন্ড মার্কেট আছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড আছে। কিন্তু এগুলোর তেমন গতি নেই। এ মার্কেটগুলোর বড় হওয়ার সুযোগ আছে। কারণ, একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। শুধু লেনদেন করে বাজার বড় করা যাবে না। নতুন বিনিয়োগকারী না আসলে মার্কেট বড় হবে না। এজন্য ভালো আইপিও প্রয়োজন। ভালো আইপিও আসলে আরও গতিশীল হবে পুঁজিবাজার।
ডিএসইর লেনদেনে প্রযুক্তির উন্নয়নে কী উদ্যোগ নেয়া উচিত?
প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে হলে আন্তর্জাতিক মানের অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম ইন্টারফেসে (এপিআই) যুক্ত হতে হবে। এর মাধ্যমে ব্রোকার হাউজগুলো নিজেদের সফটওয়্যার তৈরি করতে পারবে। এটা বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। সেগুলো অনেকটাই অতিক্রম করা গেছে।উন্নত দেশে স্টক এক্সচেঞ্জ কখনও ব্রোকারদের সফটওয়ার প্রদান করে না। তারা এপিআই লিংক দিয়ে দেয়, তা দিয়ে ব্রোকার হাউজগুলো তাদের ট্রেডিং সফটওয়্যার তৈরি করে।
এখন যে সফটওয়্যার আমরা ব্যবহার করছি সেটা ডিএসইর নিজস্ব। আমাদের এখানে অনেক ছোট ছোট ব্রোকার হাউজ আছে। তাদের আয় কম, ফলে লেনদেনও কম হয়। যাদের আয় কম তাদের জন্য এপিআই গ্রহণ যৌক্তিক হবে না। কারণ, আধুনিক এ প্রযুক্তি ব্যয়বহুল। পুঁজিবাজার বড় হয়েছে, এখন থেকে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে।
কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে চীন থেকে ৩৭ মিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তি সহায়তা পাওয়ার কথা। সেটি কি আমরা পেয়েছি?
পেলেও ব্যবহার করা হয়নি। কারণ, আমরা এখন যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তার একটি ম্যাচিং ইঞ্জিন। এর মাধ্যমে ব্রোকার হাউজগুলো তাদের প্রতিদিনের লেনদেনের তথ্য ডিএসইকে সরবরাহ করে থাকে।এটি নেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাক প্রতিষ্ঠান থেকে। অপরটি ফ্লাক্স টিটি বা ট্রেডিং সফটওয়্যার। এটার মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করা হয়। এই প্রযুক্তি নেয়া হয়েছে ফ্রান্স থেকে। দুটি প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে ডিএসইর সঙ্গে চুক্তি আছে, যার মেয়াদ শেষে হবে ২০২৪ সালে।
কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে আমরা চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও সেনজেন কনসোটিয়ামকে নিয়েছি। তারা ৩৭ মিলিয়ন ডলার বা ৩১৪ কোটি টাকার প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করবে ডিএসইতে। আগামীতে চীনের প্রযুক্তি কাজে লাগানো হবে। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে। চীনের প্রযুক্তি বাস্তবায়ন হলে পুঁজিবাজারে দৈনিক ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও কোনো সমস্যা হবে না।
পুঁজিবাজারে বাইব্যাক সম্পর্কে কিছু বলুন...
বাইব্যাকের জন্য আইন আছে। আমাদের পুঁজিবাজারে এখনও সেটা কার্যকর করা হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাইব্যাক কে করবে? কোম্পানি আইনে বলা আছে, এটা প্রতিষ্ঠান করবে।কোনো পরিচালক বাইব্যাক করতে পারে না। যদি বাইব্যাক করে তাহলে পরিচালক বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে কম দামে কিনতে পারে। এতে পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও কোম্পানির কোনো সুবিধা নেই।নিয়ম অনুযায়ী, বাইব্যাক করবে কোম্পানি। কোম্পানির যে রিজার্ভ আছে তা থেকে বাইব্যাক করবে। বিনিয়োগাকারীরা মনে করেন, বাইব্যাক হচ্ছে যখন শেয়ারের দর কমবে তখন পরিচালকরা নিজের টাকা দিয়ে শেয়ার কিনবে, কিন্তু এ ধারণা ঠিক না।
ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে সবচেয়ে বড় সমস্যা লেনদেন জটিলতা, এর উন্নয়নে পরামর্শ কী?
সিকিউরিটিজ আইন যথাযথভাবে পরিপালন করে না- এমন কোম্পানিগুলো মূলত ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেট তালিকাভুক্ত। বর্তমানে ওটিসি মার্কেটে কাগজে এবং ইলকেট্রনিক- উভয় ধরনের শেয়ার লেনদেন হয়। তবে বেশির ভাগই কাগজে শেয়ার।আমরা যখন বিকল্প মার্কেট তৈরি করব তখন ওটিসি মার্কেট থেকে ইলেকট্রনিক শেয়ারের কোম্পানিগুলোকে আলাদা করতে পারব। ফলে লেনদেন সহজ হবে।
নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে কোন বিষয়গুলোতে নজর দেয়া উচিত?
পুঁজিবাজারে খারাপ কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বিএসইসি ও ডিএসইকে দায়ী করা হয়, কিন্তু যারা কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে নিয়ে আসে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না।আইন আছে, ইস্যুয়ার পুঁজিবাজারে খারাপ কোম্পানি নিয়ে আসলে জরিমানাসহ লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে, কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ নেই।
উন্নত দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা শুধু মনিটরিং করে। নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার দায়িত্ব ইস্যুয়ারের। তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ স্টক এক্সচেঞ্জে কাগজপত্র জমা দেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এটা বিশ্বাস করে, ইস্যুয়ার যেহেতু কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে নিয়ে এসেছে, ফলে সেটা ভালো হবে।যদি কোম্পানি খারাপ হয় তাহলে জরিমানা করে ইস্যুয়ার প্রতিষ্ঠানকে কিন্তু আমাদের এখানে তা করা হয় না। ফলে ইস্যুয়াররা শুধু নতুন কোম্পানি আনার কাজটিই করে থাকে।