অতিরিক্ত দুই বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশে পদোন্নতির ভেতরে রেখেই এ সুবিধা দিতে যাচ্ছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (ইউএন-সিডিপি)।
পদোন্নতি বা উত্তরণ নিয়ে সংস্থার প্রবিধানে বলা হয়েছে, উত্তরণের সুপারিশ লাভের পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতির সময় পাবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরণ প্রক্রিয়াটি সহজ করতে বাংলাদেশকে প্রস্তুতির পূর্ণ সময় পাঁচ বছরই দেয়া হচ্ছে।
তবে এ বাড়তি সুবিধা ভোগের জন্য উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে যাচ্ছে। নতুন সময় অনুযায়ী ২০২৪ সালের পরিবর্তে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে ২০২৬ সালে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কাছে উন্নয়নশীলে বাংলাদেশের উত্তরণ সংক্রান্ত এমন সুপারিশই করতে যাচ্ছে ইউএন-সিডিপি। এ প্রক্রিয়ায় এলডিসির সুবিধা প্রাপ্তির সীমা বাংলাদেশের জন্য ২০২৭ সালের পরিবর্তে ২০২৯ সালে শেষ হবে। উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এলডিসি থেকে বাংলাদেশ প্রাথমিক উত্তরণের সুপারিশ পায় ২০১৮ সালে। চলতি বছরই এই উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভের কথা ছিল। এর মধ্যদিয়ে ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ বিশ্বে শতভাগ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করত। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই এখন উত্তরণ কালটি পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) হলো জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইকোসক) নীতি নির্ধারণী বডি। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংস্থাটির চার দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে। সম্মেলন থেকেই সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য এমন সুপারিশ করবে।
সূত্রের দাবি, এই ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে উত্থাপিত বিষয়বস্তু পর্যালোচনায় আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ১১ জানুয়ারি ইউএন-সিডিপির এক্সপার্ট গ্রুপ এক ভার্চুয়াল সভা আয়োজন করে। বাংলাদেশ ওই সভায় যোগ দিয়ে করোনায় ক্ষয়ক্ষতির কারণ দেখিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর সময় বাড়ানোর আহ্বান জানায়। ইউএনসিডিপির নীতিনির্ধারক ও এক্সপার্ট গ্রুপ বাংলাদেশের এই অনুরোধেই সাড়া দিতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উন্নয়নশীলে বাংলাদেশের উত্তরণে কোনো বাধা নেই। কারণ প্রাথমিক উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর করোনার আগ পর্যন্ত সময়সীমা বিবেচনায় এখনই উত্তরণযোগ্য বাংলাদেশ।
‘কিন্তু বাংলাদেশ বীরের বেশেই উত্তরণে যেতে চায়। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ আমাদের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে অর্থনীতির গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়েছে। একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যেও। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এলডিসির সুবিধাগুলো আরও দুই বছর অব্যাহত রাখতে আবেদন করা হয়েছে। উত্তরণের ভেতরে থেকে সুবিধাপ্রাপ্তির বাড়তি সময় পাওয়া গেলে তার চেয়ে ভালো কিছু তো বাংলাদেশের জন্য আর কিছু হতে পারে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বাড়তি সময়টির পরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবহার আমরা চাই সমন্বিতভাবে। এটা করতে পারলে মন্দা কাটিয়ে নিজেদের সক্ষমতাকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব। তাহলে আমাদের উত্তরণের পাশাপাশি উত্তরণ পরবর্তী অর্থনীতিও ঝুঁকিমুক্ত ও টেকসই হবে।’
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ তালিকায় এখন বাংলাদেশসহ ১১টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দেশের উত্তরণ ঘটেছে। দেশগুলো হলো বোতসোয়ানা ও ভানুয়াতু-১৯৯৪, কেপ ভারদে -২০০৭, মালদ্বীপ-২০১১, সামোয়া-২০১৪ এবং ইকুয়েটরিয়াল গিনি-২০১৭। আর চূড়ান্ত উত্তরণের পথে রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস ও তিমুর লেসতে (পূর্ব তিমুর)।
জানা গেছে, এর আগে উত্তরণের সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল নেপাল ও মালদ্বীপ। ভূমিকম্পের কারণে নেপাল এবং সুনামির কারণে মালদ্বীপ এই আবেদন করেছিল। ২০১৮ সালেই নেপালের উত্তরণ ঘটার কথা ছিল। তবে ভূমিকম্পের কারণে তারা তিন বছর এলডিসির বাড়তি সুবিধা নেয়। এ কারণে চলতি বছরই (২০২১) চূড়ান্ত উত্তরণের কথা রয়েছে নেপালের।
উত্তরণের তালিকায় থাকা দেশগুলোর সামগ্রিক আর্থসামাজিক পরিকাঠামো বিবেচনায় রেখেই পদোন্নতি বিবেচ্য হয় বলে জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, উত্তরণকালে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি থাকলে সিডিপি যে কোনো দেশের সময় বাড়ানোর আবেদনটি সাধারণত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়। অতীতে এর নজিরও রয়েছে। কারণ কেউ উত্তরণযোগ্য হলে এলডিসিতে আঁকড়ে থাকার সুযোগ যেমন নেই, কাউকে জোর করে বের করে দেয়ার সুযোগও নেই। এসব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশও দুই বছর বাড়তি সময় পাচ্ছে।
উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা অন্যান্য দেশও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। এ ক্ষেত্রে তালিকায় থাকা বাকি দেশগুলোর বিষয়ে সিডিপির সুপারিশ কী হতে পারে- জানতে চাইলে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যতদূর জেনেছি, বাকি দেশগুলোও উত্তরণ সময় পেছানোর আবেদন করতে যাচ্ছে। যদি করে থাকে তাহলে সবার আবেদনই গৃহীত হবে বলা যায়। অন্যদিকে সব দেশ আবেদন করলে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিডিপি ভিন্ন ভিন্ন সময় বিবেচনায় না নিয়ে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তও নিতে পারে। তা হলো ২০২১ সালের উত্তরণ প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে ২০২৪ সালের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে পর্যালোচনার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে পারে।’
উল্লেখ্য, করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এতে সরকারের সময়বাদ্ধ অনেক উন্নয়ন কর্মসূচিই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কমছে রাজস্ব আয়। বাড়ছে না রপ্তানিও। আসছে না বৈদেশিক অনুদান, স্বল্প সুদের ঋণ ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই)। চাঙ্গা হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যও। নতুন কর্মসংস্থানে চলছে মন্দা। আগের কর্মসংস্থান ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রবাসীদের দেশে ফেরার মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে। এতে বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি দরিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এসব কারণে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অর্জিত অবস্থানও ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানিতে ৬০ বিলিয়ন ডলার অর্জনের কথা বাংলাদেশের। সেই লক্ষ্যমাত্রা উত্তরণের বছরই ১৬ বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে রয়েছে দেশ। আবার এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার কারণে ২০২৪ সালের পর ক্রমাগত কমবে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা। ২০২৭ সালের পর তা একেবারেই থাকবে না। একই কারণে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব আইন কার্যকর করতে হবে, কৃষি থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে।
উত্তরণ পরবর্তী মাত্র তিন বছরের মধ্যেই সব কিছু সমন্বয় করে মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যার প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে।
সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকার উত্তরণের সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, সরকারের এই উদ্যোগ সঠিক ও সময়োপযোগী।