বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাটার টান বাটার ব্যবসায়

  •    
  • ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:০১

করোনাকালে বহুজাতিক কোম্পানি বাটার ব্যাপক লোকসান হয়েছে। বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে ১০৭ কোটি টাকার অধিক। এই ব্যাপক লোকসানের প্রভাব পড়েছে কোম্পানির শেয়ার দরে। দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে শেয়ার। 

দেশীয় পাদুকা শিল্পে বহুজাতিক কোম্পানি বাটার দাপুটে রাজত্বে ভাটা পড়েছে। করোনাভাইরাসের কালে হঠাৎ ধসে বাটার বিক্রি তলানিতে। বিপুল পরিমাণ পরিচালন ব্যয়ের কারণে লোকসান ব্যাপক।

শুধু অভ্যন্তরীণ বিক্রিই কমেনি, কমছে রপ্তানিও। এসবের প্রভাব পড়েছে মোট আয়ে।

চলতি বছর তিন প্রান্তিকে কোম্পানির লোকসান হয়েছে ১০৭ কোটি ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৬ টাকার।

দীর্ঘকাল বাংলাদেশে শীর্ষ অবস্থানে থেকেও এখন তারা ব্যবসা হারাতে বসেছে। এর কারণ অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা।

এতে উঠে এসেছে শীর্ষে থাকার লড়াইয়ে কোম্পানির বাকিতে ব্যবসার নীতি অনুসরণ এবং বছরজুড়ে স্টক লটের মাল ডিসকাউন্ট মূল্যে বিক্রিসহ আরও অনেক তথ্য।

গত এক দশকে দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও পড়তে হয়েছে বাটাকে। এই সময়ে অন্তত ডজনখানেক দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড দেশে ব্যবসার পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। তাদের নতুন নতুন স্টাইল ও ডিজাইন বাজারে সাড়া ফেলেছে এবং নিজেদের আলাদা ক্রেতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

এই সময়ে দেশে বাটার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, বে সুজ, ওরিয়ন, ইনসোল, ক্রিসেন্ট, প্রাণ-আরএফএল, ইউএস-বাংলা ও রানারের মতো প্রতিষ্ঠান। লেদারেক্স, জিলস ভাইব্রেন্টের মতো কিছু কোম্পানিও দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব শো-রুম দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে।

এর বাইরে দেশে আসছে আমদানি করা জুতাও। আকর্ষণীয় এসব জুতা বিভিন্ন শো-রুমের পাশাপাশি খোলা বাজারেও তুলনামূলক কম দামে বিক্রি হচ্ছে।

আবার সরকার নতুন ভ্যাট আইন প্রবর্তনের ফলে বেচাকেনায় এ বিষয়ক সৃষ্ট জটিলতাও ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কোম্পানির ব্যবসায় ধসের আরেকটি কারণ হচ্ছে, সারা দেশে বাটার যত পাইকারি ডিপো, হোলসেল ডিলার এবং রিটেইল আউটলেট রয়েছে, তার বেশিরভাগই সপ্তাহে গড়ে দেড় দিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে বাকি সময়ে লক্ষ্যমাত্রার পণ্য বিক্রি অর্জন হচ্ছে না।

বিক্রি কমার এই মিছিলে গত বছর মার্চে নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হয়েছে করোনার নেতিবাচক প্রভাব। এতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বাটার ব্যবসায়ও মারাত্মক ধস নামে। চলতি বছর কোম্পানিটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।

বাটার আয়ে প্রথম ধাক্কা আসে ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালে যেখানে কোম্পানির মোট আয় ছিল ৯৫২ কোটি ১৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, সেখানে পরের বছর আয় কমে দাঁড়ায় ৮৫৭ কোটি ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকায়।

যদিও এর আগের বছরগুলোতে কোম্পানির ব্যবসা তুলনামূলক ভালো ছিল। ২০১৭ সালে আয় ছিল ৯০৪ কোটি ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৫ টাকা। ২০১৬ সালে ছিল ৮৭৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫৩ হাজার ৩১৭ টাকা।

২০২০ সালের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত হয়নি। তবে কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বাটা আয় করেছে ৩৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার ২২৬ টাকা। অথচ ২০১৯ সালের একই সময়ে কোম্পানির এই আয় ছিল ৬২৮ কোটি ৪০ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৯ টাকা।

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির হাতে ২৬৬ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪ টাকার বিক্রিত পণ্যের মজুত ছিল, যা ক্রেতার অভাবে বিক্রি করা যায়নি।

এ সময় স্থানীয়ভাবে জুতা বিক্রি হয় ৩৩০ কোটি ৪৯ লাখ ৯২ হাজার ৫৪১ টাকার। আর হোসিয়ারি ও এক্সেসরিজ বিক্রি হয় ১৩ কোটি ৬৪ লাখ এক হাজার ৭৭৪ টাকার।

একই সময়ে জুতা এবং হোসিয়ারি ও এক্সেসরিজ মিলে বাটা ব্র্যান্ডের পণ্য রপ্তানি হয় ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৯১১ টাকার। আগের বছরের একই সময়ে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭৫ লাখ ৪ হাজার ১১৬ টাকার।

এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক, বিক্রয় ও সরবরাহজনিত ব্যয় হয়েছে ১৮৪ কোটি ৩৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৪ টাকা। ফলে পরিচালন মুনাফা ১০৭ কোটি ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৬ টাকা লোকসানে পরিণত হয়।

বাংলাদেশে বাটা কোম্পানির দুইটি কারখানা রয়েছে। এর একটি গাজীপুরের টঙ্গী ও অপরটি ঢাকার ধামরাইয়ে। কারখানা দুইটির সম্মিলিতভাবে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা।

২০০৯ সালে জুতা বিক্রি হয় তিন কোটি জোড়া। এর ১০ বছর পর ২০১৮ সালে জুতা বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ২৯ লাখ জোড়ায়। এরপরই কমতে থাকে বিক্রি। তবে সর্বশেষ কত কোটি জোড়ায় নেমে আসে তা এবারের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

সারা দেশে বাটা বাংলাদেশের হোলসেল ডিপো রয়েছে ১৩টি। এই হোলসেল ডিপোর মাধ্যমে ৪৭১টি অনুমোদিত হোলসেল ডিলার এবং ৬৯০টি ডিলার সাপোর্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাটা জুতা বাজারজাত হয়ে থাকে। আর বাটা সিটি স্টোর, বাটা বাজার এবং বাটা ফ্যামেলি শপসহ সারা দেশে আরও রয়েছে ২৪২টি রিটেইল আউটলেট।

বাটার নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানিটির চেয়ারম্যান রাজীব গোপালা কৃষ্ণানের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা আছে। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে দেশ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ ছুটির আওতায় ছিল। এর ফলে তারা নিয়মিত ব্যবসা হারিয়েছেন।

বাংলাদেশের ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির বিক্রিত পণ্যের ৮১ ভাগই হয়ে থাকে খুচরা চ্যানেলে। আর পাইকারি চ্যানেলে হয়ে থাকে ১৯ শতাংশ। আবার পাইকারি চ্যানেলের বেশির ভাগ বিক্রিই হয়ে থাকে বাকিতে।

‘অন্যদিকে বাটার মোট ব্যবসার ২৫ শতাংশ অবদান রাখে প্রতি বছর ঈদুল ফিতর। করোনায় সাধারণ ছুটির কারণে গত বছর আমরা তা সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছি।’

তিনি বলেন, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রাখার জন্যই ডিলারদের কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয়। তবে এই বাকি আগের বছরে তুলনায় ৩৬ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

বাটা বাংলাদেশের রপ্তানি কর্মকর্তা ইমতিয়াজ সালেহীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে টানা চার মাস কারখানা বন্ধ ছিল। আগস্টে কারখানা চালু হলেও উৎপাদন সীমিত করা হয়। আগের তুলনায় এখন উৎপাদন ৫০ ভাগ কম হচ্ছে। তা ছাড়া আগের পণ্য বিক্রি না হওয়ায় নতুন-পুরনো মিলে স্টকও বেড়েছে।’

করোনাকাল তাদের ব্যবসার কতটা ক্ষতি করেছে, তার একটি উদাহরণ দেন সালেহীন। বলেন, ‘দেশে সর্বোবৃহৎ রিটেইল শপ বসুন্ধরা সিটিতে যেখানে অন্যান্য রোজায় দিনে গড়ে এক কোটি টাকা বিক্রি হতো, গত রোজায় সেখানে এক জোড়া জুতাও বিক্রি হয়নি। এমন দিনই গেছে বেশির ভাগ সময়। অন্যান্য শো-রুমে বেচাবিক্রির অবস্থা কী ছিল এর থেকেই অনুমান করা যায়।’

ব্যবসার এই প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার দরে। গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে শেয়ার। তাও বিনিয়োগকারীদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। প্রতিদিন নগণ্যসংখ্যক শেয়ার বিক্রি হয়।

কোম্পানিটির সবশেষ শেয়ার দর ৬৪০ টাকা ২০ পয়সা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী বাটার ফ্লোর প্রাইস ঠিক হয়েছে ৬৯৩ টাকা ২০ পয়সা। কোম্পানির অবস্থা যাই হোক না কেন আপাতত এর নিচে নামবে না দাম। এই বিষয়টি না থাকলে কোম্পানির বর্তমান অবস্থায় শেয়ারদর কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা নিয়ে নিয়ে অবশ্য আছে প্রশ্ন।

১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা এক কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। বাকি শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ১৯.৪১ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ১.৮১ শতাংশ। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৮.৭৮ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন।

কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য আছে ৩৬৪ কোটি ৬৫ টাকা।

কোম্পানিটির রিজার্ভে আছে ৪৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। চলতি বছরের নয় মাসেই রিজার্ভের ২২ শতাংশ লোকসান হয়ে গেছে।

এ বিভাগের আরো খবর