চলতি অর্থবছরের অর্ধেক সময় পার হয়েছে। করোনা সংকটের মধ্যে নানা প্রতিকূলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থবছরটি যাত্রা করে। এই ছয় মাসে দেখা যায়, কিছু সূচক ইতিবাচক, আবার কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আলোচ্য সময়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি-অস্বস্তি দুটি চিত্রই উঠে এসেছে।
সরকারি নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, বাজারে করোনার টিকা আসার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়ায় অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। করোনার বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চ প্রবৃদ্ধি আশা করেছেন তারা।
তবে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতিতে ফের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব। তবে শঙ্কা যেমন আছে, আবার সম্ভাবনাও দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা।
করোনার দুর্যোগের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন অর্থনীতি নিয়ে গভীর চিন্তিত, তখন বাংলাদেশ বেশ কিছু সূচকে ভালো করেছে। সংকটের মধ্যে এসব খবর মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে দাতা সংস্থাগুলোর আশাবাদ, মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের রেকর্ড উচ্চতা, মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো জাগিয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রেমিট্যান্স দুটিই বেড়েছে। এই সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স সাড়ে ৩৭ শতাংশের বেশি।
মূলত আমদানি কমার কারণে রির্জাভ বেড়েছে। যদিও রিজার্ভ স্ফীত হওয়াকে অর্থনীতির দুর্বল লক্ষণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। অপরদিকে, দুই শতাংশ নগদ প্রণোদনা এবং বিশ্বব্যাপী হুন্ডি বন্ধের কারণে রেমিট্যান্সের জোয়ার এসেছে।
ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫.২৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল পৌনে ছয় শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় থাকার পেছনে নিয়ন্ত্রিত খাদ্যপণ্যের দাম সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে বলে ধারণা করা হয়।
গত এক দশকের ব্যবধানে দেশে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার।
এ ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, মাথাপিছু আয় দ্রুত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করেছে।
এ বছর আরেকটি সুখবর অপেক্ষা করছে।
২০১৮ সালেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে।
তিন বছর পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চূড়ান্ত যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা আসতে পারে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) আগামী ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে বসবে।
অর্থনীতির চাঙাভাব ধরে রাখতে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশই গভীর চ্যালেঞ্জে পড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বহু দেশের জিডিপি সংকুচিত হচ্ছে ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য দেশের তুলনায় ভালো আছে, এমন আভাস আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি)।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা বলা কঠিন। এতে রপ্তানি কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে যতটা খারাপ আশংকা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি। সংকটের মধ্যেও দেশের অর্থনীতি মোটামুটি ভালো চলছে বলে মনে করেন তিনি।
সুখবরের মধ্যেও কিছু খারাপ খবর আছে। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অবদান রাখা দেশের তৈরি পোশাক খাতে ফের কালো মেঘের ছায়া জমেছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে খুলছে না বাংলাদেশের শ্রমবাজার। কাজে যোগ দিতে পারছে না অনেক শ্রমিক। বেসরকারি খাত অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলেও ঋণ বিতরণ বাড়েনি ব্যাংক খাতের।
বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতাও উল্লেখ করার মতো নয়। বেসরকারি বিনিয়োগে খরা চলেছ এখনও। সরকারি আয়ের অন্যতম রাজস্ব আদায় কিছুটা বাড়লেও লক্ষ্য অর্জন থেকে বহুদূর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নিবার্হী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রথমে ধারণা করেছিলাম মার্চ-এপ্রিলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে অর্থনীতি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আরও সময় লাগবে। তবে আতঙ্কের কিছু নেই। আবার উৎফুল্ল হওয়ারও কিছু দেখছি না।’
চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানিতে তেজিভাব লক্ষ্য করা গেলেও ডিসেম্বরে ছন্দপতন ঘটে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আয় কমেছে শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে।
ইউরোপ বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে যুক্তরাজ্য, জামার্নিসহ ইউরোপের অনেক দেশে লকডাউন চলেছে। ফলে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ক্রেতারা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এটা আমাদের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।’
বাণিজ্যমন্ত্রী গত রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ঝুঁকি বাড়ছে পোশাক খাতের।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমেছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ।
আমদানির বড় একটি অংশ খরচ হয় শিল্প স্থাপনে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালে। কিন্তু এই সময়ে যে তথ্য মিলেছে, তাতে দেখা যায়, এসব পণ্য খুব কমই এসেছে। এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে খরা চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় বেড়েছে (প্রবৃদ্ধি) মাত্র ২.১০ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এ বছর রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তাতে প্রবৃদ্ধি হতে হবে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ। ফলে লক্ষ্য অর্জন থেকে এখনও বহু দূরে এনবিআর।
উন্নয়ন কাজ তথা এডিপি বাস্তবায়ন খুব একটা গতি পাচ্ছে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আইএমইডির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আলোচ্য অর্থবছরের ছয় মাসে টাকা খরচ হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ২৪ শতাংশ।
গত অর্থবছরের এই সময় বাস্তবায়নের হার ছিল ২৬.৫৯ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা বলেছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে কাজের গতি বাড়ে।
বেসরকারি খাত কতটুকু গতিশীল, তা বোঝা যায় ব্যাংকের ঋণ বিতরণের চিত্র থেকে। মূলত গত জুন থেকে ব্যক্তিখাতে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। মাঝখানে একটু বাড়লেও এখন তা আবার নিম্নমুখী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.২১ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।
এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট না কাটায় ঋণের চাহিদা বাড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, এখন যে ঋণ দেয়া হচ্ছে, তার বেশিরভাগই চলতি মূলধন। নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। ফলে ঋণের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসছে না।