করোনা পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রণোদনার পাশাপাশি আগের ঋণ পরিশোধে আরও সময় চায় শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
সংগঠনের সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, করোনার প্রথম ধাক্কা তারা কোনো রকমে কাটিয়ে উঠেছেন। তবে ইউরোপে দ্বিতীয় ধাক্কার পর এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সরকার সহায়তার হাত না বাড়ালে উত্তরণ কঠিন হবে।
শনিবার রাজধানীতে এক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে রুবানা এসব কথা বলেন।
‘করেনা পরিস্থিতিতে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে কি গার্মেন্ট খাত পুনরুদ্ধার সম্ভব?’- এ বিষয়ে এই সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ফর ডায়ালগ- সিপিডি।
সরকারের নীতি সহায়তা চেয়ে রুবানা বলেন, ‘আগে পোশাকখাতে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তার পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধাসহ দুই বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছরে পরিশোধে মালিকদের দাবির প্রতি সরকার সহানূভূতিশীল হবেন। পাশাপাশি নতুন করে প্রণোদনার উদ্যোগ নেবেন।’
গত মার্চে করোনা মহামারি শুরুর পর পোশাক খাতের রপ্তানি থমকে দাড়ায়। শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন পরিশোধ করতে চার শতাংশ সুদে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় পোশাক খাতে। জুলাই মাসে দেয়া হয় আরও প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এই ঋণ আসছে চলতি জানুয়ারি থেকে পরিশোধের কথা ছিল।
তবে ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার পর পোশাক রপ্তানিতে আবার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
রুবানা বলেন, ‘করোনার প্রথম ধাক্কায় রপ্তানি খারাপ অবস্থায় এসেছিল। সেটা মোটামুটি ওভারকাম করা গেছে। কিন্তু এখন আবার দ্বিতীয় ওয়েভে আবারও এর গতি শ্লথ হয়ে গেছে। দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। যা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।’
শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে রুবানা হক বলেন ‘নিশ্চয় আপনারা আমাদের গালি দেবেন। গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। অধিকার চাইবেন। কিন্তু এখন সেই সময়টি না। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংকট মোকাবেলা করি।’
ঐক্যের ডাক
সংলাপে পোশাকখাত পুনরুদ্ধারে ঐক্যের ডাক দেন, মালিক-সরকার ও শ্রমিক নেতারা।
তারা বলেন, এখন বিভেদের সময় নয়। দরকার সব পক্ষের ঐক্য। এই ঐক্যবদ্ধ চেষ্টাই পারবে বৈশ্বিক এই সংকটে পোশাক খাতকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে।
বক্তারা বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় পোশাক খাত আবারও সংকটে পড়েছে। এটা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নয়, বৈশ্বিকও। যা কারও একার পক্ষে মোকাবিলা সম্ভব নয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন ‘দ্বিতীয় ওয়েভের কারণে সরকার নিশ্চয় পোশাকখাতে আবারও সাহায্যের হাত বাড়াবে। আগে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তার মেয়াদ আরও বাড়ানো দরকার। এ বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করবে।’
শ্রমিকদের সহানুভূতি দেখানোর অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘এই সংকটের মধ্যেও শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের বিশেষ নজর রাখতে হবে, যাতে কোনো অবস্থায় শ্রমিকরা বিপদগ্রস্ত না হয়।
‘পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে শ্রমিকদের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বায়াররা। তাই বায়ারদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে এই শ্রমিকদের কথা ভাবতে হবে।’
সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘করোনায় পোশাকখাতে সাপ্লাই চেইনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে। কমেছে দামও। শ্রমিকদের এতে সমস্যা হচ্ছে। এটা একটা চক্রাকার সমস্যা। যার সমাধান সম্মিলিত উদ্যোগেই সম্ভব। এটা যত দ্রুত হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।’
সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পোশাকখাত এখন বৈশ্বিক মূল্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে। কীভাবে এর চ্যালেঞ্জ উত্তরণের মধ্যদিয়ে খাতটি টেকসই করা যায়, সেটাই সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। নতুবা এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে।’
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এইআর হ্যারি ভারওয়েইজ বলেন, ‘করোনা সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বায়াররাও। অনেক চেইন শপ বন্ধ। চাহিদা এবং দাম দুটোই কমেছে। তবে পরিস্থিতি এরকম থাকবে না। নিশ্চয়ই সমস্যা একদিন আমরা কাটিয়ে ওঠব। তাই বায়ারদেরও শ্রমিক স্বার্থে দাম পুনঃমূল্যায়নে মনোযোগী হওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ওয়াকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘শ্রমিকরা খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। মালিকদের উচিত শ্রমিকদের সুরক্ষায় নজর রাখা। এক্ষেত্রে মালিক, বায়ার এবং সরকারকে এই তিন পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে বায়ারদেরই দায়ভার বেশি বহন করতে হবে।’
শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমরা পোশাকখাতকে অবশ্যই বাঁচাব। তবে মালিকদেরও শ্রমিকদের কথা চিন্তা করতে হবে।’
মূল প্রবন্ধে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালে যখন বিশ্ব অর্থনেতিক মন্দা তৈরি হয়েছিল তখনও তৈরি পোশাকখাত এত বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েনি।
‘এর কারণ হচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তা এবং বৈশ্বিক ক্রেতা কেউ-ই এ সংকটের সঙ্গে পরিচিত নয়। ফলে পোশাকের সাপ্লাই চেইনে একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দাম ও চাহিদা কমায় দেশে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ফলে পোশাকখাতে শ্রমিক ছাঁটাই, কারখানা লে অফ, ওভারটাইম হ্রাস, মজুরি কম সব কিছুই ঘটছে। এর পুনরুদ্ধার যদি দ্রুততর না হয় এবং সহজীকরণ না হয় তাহলে এসডিজির অর্জন ব্যাহত হতে পারে।’