পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক উত্থানেও খুব বেশি নড়চড় নেই বাজার মূলধনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা ব্যাংকের শেয়ারে। যদিও কয়েক বছর ধরে লভ্যাংশ ঘোষণার ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে, এই খাতের কোম্পানিগুলোর বেশ কয়েকটিতে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা পাওয়া গেছে।
গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৫০০ পয়েন্টের বেশি। এই মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যাংকের শেয়ারের অবদান খুব একটা বেশি নয়।
এর আগে নানা সময় দেখা যায়, বড় উত্থান হলে ব্যাংকের শেয়ারের হাত ধরেই হয়। কিন্তু এবার সেটি হয়নি।
তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৮টির দাম ২০ টাকার কম। এর মধ্যে দুটির আবার অভিহিত মূল্য ১০ টাকার কম। এর একটি অবশ্য কখনো মুনাফা দেয়নি। অন্য একটি কখনো ১০ শতাংশের কম মুনাফা ঘোষণা করেনি।
গত বছর এসব ব্যাংকের মধ্যে মুনাফা দিয়েছে ২৭টি। এর মধ্যে ১০টিরও বেশি ব্যাংকে বিনিয়োগ করে যেকোনো সঞ্চয়ী হিসাবে সুদ হারের চেয়ে বেশি হারে আর্থিক লভ্যাংশ পেয়েছেন। আকর্ষণীয় বোনাস লভ্যাংশও দিয়েছে আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক।
এটা কেবল এক বছর নয়, গত পাঁচ বছরেই দেখা যায়, শেয়ারের দামের তুলনায় লভ্যাংশ যেকোনো সঞ্চয়ী হিসাবের সুদ হারের চেয়ে বেশি ১০টি ব্যাংকের। কোনো কোনো ব্যাংকে এটি বর্তমান আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হারের দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি। এর পাশাপাশি মিলেছে বোনাস লভ্যাংশ।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ে যে নেতিবাচক প্রচার আছে, তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো সত্য সত্য ভালো মুনাফা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের মন্দ ঋণের পরিমাণও অনেক। এটা কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে তারা শেয়ার কিনতে আগ্রহী হয় না।’
অন্য খাতের তুলনায় ব্যাংকের দাম কতটা কম, তা বোঝা যায় একটি পরিসংখ্যানে। ব্যাংকের শেয়ারের ক্ষেত্রে যেখানে বেশির ভাগের দাম ২০ টাকার নিচে, সেখানে সাধারণ ও জীবনবিমা খাতের ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে ৩০ টাকার নিচে আছে মাত্র সাতটি।
অথচ এক বছর আগে এই খাতের শেয়ারের বেশির ভাগের মূল্যই ১০ থেকে ২০ টাকার মধ্যে ছিল।
ঢাকার একটি ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার লেনদেন দেখছেন। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
ব্যাংকের স্বাস্থ্যের তুলনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেশ খারাপ। এই খাতের ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত কয়েক বছরে নানা কেলেঙ্কারিতে নাম আসা নয়টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর তলানিতে। এদের কোনোটি মুনাফায় নেই, বরং শেয়ারপ্রতি বিপুল পরিমাণ লোকসান থাকায় লভ্যাংশ ঘোষণার সম্ভাবনা শূন্য বলা যায়।
বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটির দাম ব্যাংকের শেয়ারের তুলনায় বেশ ভালো। যদিও এগুলোর চেয়ে ব্যাংকের আয় এবং লভ্যাংশের ইতিহাস ভালো।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ মনে করেন, ব্যাংকের শেয়ারের দাম যতটা থাকতে পারত, তার চেয়ে কম। অনেকগুলোর দামই অবমূল্যায়িত অবস্থায়।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের শেয়ারের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেন তারা খুব বেশি আগ্রহী হন না। তারা জানেন এত শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সম্ভব নয়। কম শেয়ার আছে এমন কোম্পানির শেয়ারের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।’
‘মুনাফা বাড়ার খবরের চেয়ে মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এটি বিনিয়োগকারীদের বেশি প্রভাবিত করে’, বলেন আবু আহমেদ।
খারাপ শেয়ারের দামে সূচক বাড়লে লাভ নেই
সূচক প্রায় ছয় হাজার পয়েন্টে পৌঁছে গেলেও বাজার নিয়ে এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন আবু আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে তার অনেকগুলোই খারাপ কোম্পানি। পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি হচ্ছে ব্যাংক খাতের শেয়ার, যার দাম এখন তলানিতে। একবার দাম বাড়লে এক সপ্তাহ বাড়ে না; বরং কমে আগের পর্যায়ে আসে।
‘এমন অবস্থায় সূচক বাড়লে বাহবা নেয়ার কিছু নেই; বরং ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে আরও সম্প্রসারিত করা উচিত। আর খারাপ কোম্পানির শেয়ার মূল্য বাড়ার বিষয়টি দেখা উচিত।’
তদন্তের উদ্যোগ ভালো, প্রক্রিয়া নয়
পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক উত্থানের পর মঙ্গলবার গত ৩০ কার্যদিবসে ৫০ শতাংশের বেশি উত্থান হওয়া কোম্পানিগুলোর বিষয়ে তদন্ত করতে চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এই চিঠিতে আবার আতঙ্কে বড় ধরনের দরপতনের পর বিএসইসি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এরপর বাজারে আবার উত্থান হয়।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান মনে করেন, বিএসইসির সেই উদ্যোগটি ভালো ছিল। তবে প্রক্রিয়াটি ঠিক ছিল না।
তিনি বলেন, ‘সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমস আছে, যার মাধ্যমে কোন কোম্পানির শেয়ারে কী ধরনের কারসাজি হচ্ছে তা যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। ঢালাওভাবে ঘোষণা দিয়ে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা পুঁজিবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে বাজারের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়।’
বৃহস্পতিবার ব্রোকার হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলোচনা ছিল বিএসইসির সিদ্ধান্ত নিয়ে।
বিনিয়োগকারীরা বলছে, পুঁজিবাজারে সব কোম্পানি ভালো এটা বলা যাবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সময় সময় অনেক কোম্পানির সার্বিক লেনদেন পর্যালোচনা করতে পারে।
ঘোষণা দিয়ে তদন্ত করা হলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, যার প্রভাব বুধবার দেখা গেছে।
আবু আহমেদ বলেন, ‘বিএসইসি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, সেটা খারাপ ছিল না। বর্তমানে অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়িত হয়েছে। তদন্ত করা হলে সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরত।’
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএসইসি পুঁজিবাজারের স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেহেতু সিদ্ধান্তগুলো পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক ছিল না, তাই পরিবর্তন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্দেশনায় কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ না থাকায় মূলত আতঙ্ক ছড়িয়েছে।’