আমানতকারীরা হচ্ছেন ব্যাংকের রক্তপ্রবাহ, তাদের সুবিধা কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা বাড়ানো সঠিক হয়নি বলে মনে করছেন বিশিষ্ট ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন। তিনি বলেছেন, আমানতকারীদের সুরক্ষা সরকারকেই দিতে হবে।
বেসরকারি খাতের এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন মনে করেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমে গেছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবি এর সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন মনে করছেন, অনিশ্চয়তা কেটে গেলে ঋণের চাহিদা বাড়বে। তখন অর্থনীতি আরও বেগবান হবে।
করোনাকালে দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকখাতের পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু কাওসার ও শেখ শাফায়াত হোসেন।
প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সঠিক সময়ে, অর্থাৎ এপ্রিলে প্যাকেজের ঘোষণা আসে। ঋণ নির্ভর এই প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের পর প্রণোদনা বিতরণ শুরু হয়।
মানুষ যখন দেখে সরকার তাদের সঙ্গে আছে তখন তারা ভরসা পায়। সবগুলো প্যাকেজের ঋণ বিতরণ শেষ হয়নি এখনও। বিশেষ করে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিতরণ অনেক কম। এ জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে।
দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক প্রভাবশালী। তারা প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বেশি নিতে সক্ষম হয়েছে।
প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার কারণে ব্যবসায়ীরা আস্থা পেয়েছেন যে, ব্যবসা করতে অন্তত টাকার অভাব হবে না। এ কারণে অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমি মনে করি, এটা বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে পোশাক খাত থেকে। ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পোশাক খাত করোনা মহামারির সময় শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন দিতে পারেনি। সরকারকে দিতে হয়েছে, এটা হতাশার কথা।
ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে সরকারের কাছে হাত পাততে না হয়, সে জন্য একটি তহবিল গঠনের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে পোশাক মালিকদের।
অর্থনীতি আগের চেহারায় ফিরে আসতে কত সময় অপেক্ষা করতে হবে?
এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ, আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক-তৃতীয়াংশই বিদেশি বাণিজ্য নির্ভর।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো পুরোপুরি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেনি এখনো। করোনাকালীন আমদানি কম হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে চাইলেই বিনিয়োগ করা যাবে না।
দেশের অর্থনীতি আগের চেহারায় ফিরে যাবে তখন, যখন করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণ হলেই হবে না, সারা বিশ্বে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে হবে।
টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। টিকার কার্যকারিতা দেখে অনুমান করা যাবে, জুনের পর দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে অর্থনীতি আগের চেহারায় ফিরে যেতে চলতি বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আগামীতে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের মতো থাকবে কি-না, এটা বলা কঠিন। তবে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের গতি যেমন আছে তেমন থাকলেও চলবে।
তবে স্বাভাবিক সময়ে অন্য বছরে যত লোক কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে, বিদায়ী ২০২০ সালে তেমনটা যেতে পারেনি। উল্টো দুই-তিন লাখ লোক ফেরত চলে এসেছে। বিদেশ ফেরত লোকগুলোর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
কৃষি এবং এসএমই শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও মেগা প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন দ্রুত করতে হবে। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান না করা গেলে তৈরি হবে সামাজিক অস্থিরতা। চালু করা যেতে পারে বেকারভাতা।
বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের ধীর গতির কারণ কী?
ধীরগতি বললে ভুল হবে। অনেক বেশি ধীরগতি। লকডাউন তুলে নেয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে গতি কিছুটা মন্থর হয়ে পড়ে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ঋণ বিতরণ সেভাবে বাড়েনি। সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অনিশ্চয়তা কাটলে ঋণের চাহিদা বাড়বে। ব্যাংকে তারল্য সংকট নেই, এটা ভালো দিক। এছাড়া বৈদেশিক লেনদেনের চাপ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত রিজার্ভ রয়েছে।
বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও অবকাঠামো বিনিয়োগ হচ্ছে সরকারি খাতে, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
তারপরেও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতেই হবে। রপ্তানির গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। তা না হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না দেশের অর্থনীতি।
ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এর দায় কি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে?
নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়ার কারণেই মূলত ব্যাংক খাতে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে সবারই দায় আছে। তবে প্রকৃত কারণেও অনেক সময় গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
এ ছাড়া অনিয়মের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টি অনেক সময় সাপেক্ষ। আদালতে ব্যাংকের অনেক মামলা আটকে আছে। অর্থঋণ আদালতে রায় হলে সংক্ষুব্ধ গ্রাহক রিট করেন। ফলে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়।
ব্যাংক খাতে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?
আমানতকারীদেরকে বলা হয় ব্যাংকের রক্তপ্রবাহ। তাদের সুবিধা কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আমানতকারীরা কোনো অপরাধ করেননি, বরং ঋণ নিয়ে টাকা ফেরত দেন না গ্রহীতারা।
আমানতকারীদের সুবিধা কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে ঋণের সুদ কমানো যেত।
ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ আছে, সেগুলোর প্রভিশন করতে গিয়ে ব্যাংকের ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংক খাতের যে সব প্রশাসনিক ব্যয় আছে তা নিয়ন্ত্রণ করে ঋণের খরচ কমানোর সুযোগ রয়েছে।
আমানতকারীদের সুরক্ষা কে দেবে?
দেশের জিডিপির তুলনায় সঞ্চয় অনেক কম। যারা সঞ্চয় করছেন, তাদের সমাদর করা উচিত। প্রবাসী আয় নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার সময় তাদের যেভাবে হেনস্তা করা হয় তার প্রতিকার নেই।
ব্যাংকে খাতে এখনও সবচেয়ে বেশি আমানত সাধারণ নাগরিকের। আমানতকারীদের সুরক্ষা সরকারকেই দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবা উচিত।
সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংক আমানতে খুব সামান্য মুনাফা। উপরন্তু আবগারি শুল্ক–মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর কেটে রাখা হয়।
ব্যাংকের প্রশাসনিক খরচ কিছুটা কমিয়ে, আমানতের সুদ কিছুটা বাড়িয়ে এবং আবগারি শুল্ক ও অন্যান্য করছাড় দিয়ে আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।