উন্নয়নে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন আর নতুন কোনো তথ্য নয়। বছর বছর দুই দেশের মধ্যে নানা সূচকে বাড়ছে ব্যবধান। আর এর প্রভাব পড়েছে দুই দেশের মুদ্রার মানেও। এখন বাংলাদেশের টাকার মান পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের ১০০ টাকায় পাকিস্তানে পাওয়া যায় ১৮৯ রুপি। অথচ স্বাধীনতার পরপর চিত্রটা ছিল পুরো উল্টো। তখন পাকিস্তানের একশ রুপির মান ছিল বাংলাদেশের ১৬৫ টাকা।
২০১৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ ও মুদ্রানীতি বিভাগের যৌথ এক গবেষণাপত্রে বলা আছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রথম মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময় যুক্তরাজ্যের এক পাউন্ড স্টার্লিংয়ে পাওয়া যেত বাংলাদেশি ১৮ দশমিক ৯৬ টাকা।
তখন পাউন্ডের বিপরীতে পাকিস্তানের মুদ্রার মান ছিল ১১ দশমিক ৪৩ রুপি।
সেই হিসাবে পাকিস্তানি তখন এক রুপির বিপরীতে বাংলাদেশকে খরচ করতে হতো এক দশমিক ৬৫ রুপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে কাজ করতেন। ফরেন এক্সচেঞ্জ’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। তবে ’৭২ সালেও আমরা ডলারের সঙ্গে টাকার একটি বিনিময় হার বের করেছিলাম। তখন এক ডলারের বিপরীতে ৭ দশমিক ৮৬ টাকা এবং পাকিস্তানের ৪ দশমিক ৭৬ রুপি ছিল।’
তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির দীর্ঘকাল পরও পাকিস্তানের মুদ্রা বেশ শক্তিশালী ছিল। তবে সেই অবস্থানে এখন আর নেই দেশটি। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণ ও মূল্যস্ফীতির চাপে রুপির অবস্থান এখন বেশ নাজুক।
বরং বাংলাদেশের টাকা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রায় পরিণত হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফ আলী বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন শুরু ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। এর আগে পাকিস্তানের রুপি দিয়েই হতো লেনদেন। তবে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হয়েছিল টাকা প্রচলনের আগেই।
তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে শর্ত দেয়া হতো যে, একবার একটি বিনিময় হার ঠিক করা হলে আইএমএফকে না জানিয়ে সেই হার পরিবর্তন করা যাবে না। এ ধরনের বিনিময় হার নির্ধারণকে ফিক্সড রেট পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে ফ্লোটিং রেট পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তিত হচ্ছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরের বছর থেকে পাকিস্তানে চালু হয় নিজস্ব মুদ্রা রুপি। সে সময় থেকে দেশটি ব্রেটন উডস পদ্ধতিতে বিনিময় হার বেঁধে দিত। তখন এক ডলার কিনতে তাদের ব্যয় করতে হতো তিন রুপির কিছু বেশি।
বর্তমানে এক ডলার কিনতে পাকিস্তানি মুদ্রায় খরচ হয় ১৬০ দশমিক ৫৪ রুপি। যেখানে বাংলাদেশের খরচ হয় ৮৪ দশমিক ৭৮ টাকা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকার কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। আর অর্থনীতি দুর্বল অবস্থানে যাওয়ার ফলে একের পর এক দেশটির মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে।
২০০৮ সালকে ধরা হয় পাকিস্তানের রুপির বিনিময় হারের পতনের বছর। ওই বছর মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে রুপির দর ৬১ থেকে এক ধাক্কায় ৭৯ রুপিতে পৌঁছায়।
ওই বছরের আগস্টে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রুপির পতনের সাময়িক অবসান ঘটে।
গত এক দশকে মুদ্রার মান অর্ধেকে নেমেছে পাকিস্তানে। যদিও এই সময়ে পাকিস্তানকে সুইডেন বানানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যয় করতে হয় ১০৪ থেকে ১০৫ রুপি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এক ডলারের দর ছিল ১০৯ রুপি।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৭১৪ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বর চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে ৭৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫৭ কোটি ডলার।
গত তিন অর্থবছরেই পাকিস্তান প্রায় সাত লাখ কোটি রুপির বাজেট করেছে। যেখানে প্রতিবারই তিন লাখ কোটি রুপির বিশাল ঘাটতি ধরা হয়েছে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে। গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।
পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্ধেকের কম।
গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। একই সময়ে পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল দুই হাজার কোটি ডলার।
তবে পাকিস্তানকে ‘নষ্ট’ রাষ্ট্র উল্লেখ করে তার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো তুলনা করতে চান না বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। এ দেশের তুলনা চলে ভারতের মতো দেশের সঙ্গে।’
গত কয়েক বছরে ভারতীয় রুপির সঙ্গেও টাকার বিনিময় হারের ব্যবধানও কমে এসেছে। এই ব্যবধান আরও কমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
বর্তমানে এক ভারতীয় রুপির পেছনে ব্যয় হচ্ছে এক টাকা ১৩ পয়সা। কয়েক বছর আগে এই হার এক টাকা ২৪ পয়সা ছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম আশা করছেন, কোনো দুর্যোগ না হলে ভারতের রুপির চেয়ে টাকার মান একসময় বেড়ে যাবে ।
গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক পূর্বাভাসে বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে।
আইএমএফের ওই প্রতিবেদনে (ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক) বলা হয়, ভারতের অর্থবছর শেষ হবে আগামী বছরের মার্চে। এই অর্থবছরে ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থবছর শেষ হবে জুনে; মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। তখন মুদ্রা বিনিময়ে ভারতীয় রুপিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে টাকা।