একটা সময় অভিজাত কোনো আপ্যায়নে প্লেটে মানসম্পন্ন বিস্কুট অনিবার্যভাবে হতো বিদেশি ব্র্যান্ডের। এখন এমনকি ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসেও বাংলাদেশের কোম্পানির বিস্কুট পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
স্বাদ আর বৈচিত্র্যে বিপ্লব ঘটেছে দেশীয় বিস্কুট শিল্পে। দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন বিচিত্র স্বাদের বিস্কুট বাজারজাত করছে। শুধু স্বাদই বাড়ছে না, বাড়ছে আধুনিক শৈল্পিক প্যাকেটের জৌলুসও।
২০ বছর আগেও বিস্কুট বলতে দেশের মানুষ চিনত নাবিস্কোর ‘গ্লুকোজ’ আর আল-আমিনের ‘পাইন-অ্যাপেল’।
বিস্কুটের বাজারের চিরায়ত অনানুষ্ঠানিক চিত্রটি পাল্টেছে। এ খাতে বড় করপোরেট কোম্পানির আবির্ভাব ঘটছে। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় শতাধিক বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছে ৩০টি কোম্পানি। এসব কোম্পানি অন্তত ২০০ ব্র্যান্ডের বিস্কুট উৎপাদন করছে। দেশি সুপারশপগুলোর বিস্কুটের আলমারি এখন এসব দেশি ব্র্যান্ডের দখলে।
বিস্কুটের বাজারে দেশি কোম্পানিগুলোর এমন আধিপত্যের কারণে এ খাতে এখন বিদেশি কোম্পানির প্রবেশের সুযোগ নেই বললেই চলে।
বিস্কুটের বাজার মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত। প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত বিস্কুট, সাধারণ বেকারিতে তৈরি বিস্কুট, এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ডের বিস্কুট।
বিস্কুট প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) প্রেসিডেন্ট মো. শফিকুর রহমান ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে জানান, দেশীয় বিস্কুটের ব্যবসা প্রসারের দুটি ফর্মুলা আছে: প্রোডাক্ট বিজনেস ও ব্র্যান্ডিং। বিস্কুট খাতের প্রতিনিধিত্বকারী উদ্যোক্তারা দুই ক্ষেত্রেই ভালো করছে। তিনি চান, সব প্রোডাক্টেই ভাল করুক উদ্যোক্তারা।
তিনি জানান, তিন কারণে দেশে ভালো করতে পারছে না বিদেশি কোম্পানিগুলো। প্রথমত দেশেই এখন নানা স্বাদের বৈচিত্র্যময় মানসম্পন্ন বিস্কুট উৎপাদিত হচ্ছে। একেক দেশের বিস্কুটের স্বাদের প্রতি ঝোঁক থাকে একেক রকম। বাংলাদেশি ভোক্তাদের রুচি দেশি কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে ভালো বোঝে ও তারা সেভাবেই পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারে টিকে থাকার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয় কারণ মেয়াদ সংক্রান্ত। দেশে উৎপাদিত বিস্কুট সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। কিন্তু বিদেশি একটি বিস্কুট ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় কয়েক মাস। ফলে দেশি বিস্কুট সবসময়ই বিদেশি বিস্কুটের তুলনায় টাটকা থাকে।
তৃতীয়ত, আমদানিতে শুল্কহার অনেক বেশি হওয়ায় বিদেশি বিস্কুটের দাম অনেক বেশি পড়ছে। দাম ও বিতরণ পদ্ধতিতে পিছিয়ে থাকার কারণেই বিদেশি কোনো কোম্পানি এ দেশে ভালো করতে পারবে না। এ কারণে ভারতের ব্রিটানিয়া ও পার্লেজি এবং শ্রীলঙ্কার সিলং কোম্পানি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করেও সেভাবে বাজার ধরতে পারছে না।
বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বিস্কুট উৎপাদনে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি কোয়ালিটিতে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আমরা যত স্বাদ-বৈচিত্র্য যোগ করতে পারব এবং ফুড সেফটি, হাইজিন নিশ্চিত করার ধারা অব্যাহত রাখা গেলে শুধু দেশে নয়, বিশ্ববাজারেও আমাদের অবস্থান সংহত হবে।’
বাজার অংশীদারিত্ব বিবেচনায় দেশের বাজারে বড় স্থান দখল করে অলিম্পিক বিস্কুট। এর কোম্পানি সচিব মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘একসময় হক, নাবিস্কো বড় পরিসরে বিস্কুট উৎপাদন করত। পরে অলিম্পিকসহ বড় কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় নেমেছে। এতে ব্যাপক ব্র্যান্ডিং হয়েছে এবং পণ্য বহুমুখীকরণ হয়েছে।
‘নানা স্বাদ ও মানের বিস্কুট এসেছে বাজারে। এখন দেশের বাজারে অলিম্পিকের মার্কেট শেয়ার ২৩ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘বিস্কুটে সব আইটেমই আমরা উৎপাদন করতে চাই, যাতে ভোক্তা যে পণ্য চাইবে, সেটিই যেন অলিম্পিকের হয়। তার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে অলিম্পিক।’
যেভাবে উত্থান বিস্কুট শিল্পের
গত এক দশকে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। দারিদ্র্য পরিস্থিতিরও লক্ষ্যণীয় উন্নতি হয়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, সেই সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারায় আসছে পরিবর্তন। মানুষ ডায়েটে মনোযোগী হচ্ছে এবং ক্ষুধা নিবারণের মতো হালকা খাবারে ঝুঁকছে।
বিস্কুট এখন একটি পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হয়ে উঠছে। কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান এতে যুক্ত করছে। ফলে এখন ১০ টাকার এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়েই একজন এক বেলা পার করতে পারছে।
বিস্কুট কোম্পানিগুলো এই পরিবর্তনের স্রোতে ভোক্তার নতুন চাহিদা ও রুচিবোধকে ধরতে পেরেছে। তা ছাড়া ক্রমেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকায় পণ্য চলে যাচ্ছে ছোট ছোট শহরে, গ্রামে। এভাবে বিস্কুটের বাজার বেড়েছে।
পাশাপাশি দেশে সহজলভ্য শ্রম ও সরকারের নীতি সহায়তা বিস্কুটের বাজার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের দাবি অনুযায়ী, এ শিল্পে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে মাত্র ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা এবং বিদেশি বিস্কুট আমদানিতে ৩০০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করে দেয়ায় দেশি বিস্কুটের বাজারের অভাবনীয় সম্প্রসারণ ঘটেছে।
বাজার কত বড়
দেশে বিস্কুটের বাজার কত বড়, এ নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। কারণ এ খাত সংশ্লিষ্টরা কোনো সমীক্ষা পরিচালনা করেননি। তা ছাড়া বিস্কুট উৎপাদনে শতাধিক কোম্পানি থাকলেও তাদের সবাই বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) সদস্য নয়।
সমিতির সদস্য উদ্যোক্তা হিসেবে ৭০ কোম্পানির নাম থাকলেও তারা ব্যবসায়িক গোপনীয়তার স্বার্থে বার্ষিক লেনদেনের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে না। ফলে দেশে বিস্কুটের বাজার নিয়ে রয়েছে তথ্য বিভ্রান্তি।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি টাকা, ১০ হাজার কোটি টাকা এবং ১২ হাজার কোটি টাকার বাজার থাকার তথ্য মিলেছে।
গত নভেম্বরে বিএবিএমএ প্রেসিডেন্ট নিউজবাংলাকে জানান, দেশে বর্তমানে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিস্কুটের বাজার রয়েছে। সরকার যে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করেছে, তার আওতায় প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকার বিস্কুট সরবরাহ করছে দেশি কোম্পানিগুলো।
ভোগ এবং বাজার বাড়ছে
দেশে প্রতি বছর ১৫ শতাংশ হারে বিস্কুটের বাজার বাড়ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়তে থাকায় এবং দাম কম হওয়ায় এর বাজার প্রসারের হার আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কারণ সামগ্রিকভাবে বিশ্বে বিস্কুটের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ হারে।
তা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভোগ বিবেচনায় বাংলাদেশে বিস্কুটের ভোগ এখনও কম। শ্রীলঙ্কায় মাথাপিছু বিস্কুটের ভোগ প্রতি বছর ৪ কেজি। এ ছাড়া পাকিস্তানে ২ দশমিক ৫ কেজি ও ভারতে ২ দশমিক ২ কেজি। সেখানে বাংলাদেশ ১ দশমিক ৮ কেজি।
কার বাজার কত
দেশের বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও ২২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার রয়েছে অলিম্পিক কোম্পানির। এরপর মার্কেট শেয়ার বিবেচনায় প্রাণ-আরএফএল ৮ শতাংশ, নাবিস্কো ৮ শতাংশ, ড্যানিশ ৫ শতাংশ, হক ৫ শতাংশ, আল-আমিন ৫ শতাংশ। বাকি সব কোম্পনির মিলে মার্কেট শেয়ারের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে বঙ্গজ, রোমানিয়া, ডেকো, গ্লোব, ফু-ওয়াং, বনফুল, কিশোয়ান, থাই ফুড, বেঙ্গল, গোল্ড মার্ক, কোহিনুর, মাশাফি, নিউ অলিম্পিয়ার ২-৩ শতাংশ হারে বাজার অংশীদারিত্ব রয়েছে।
দেশের বিস্কুট বিদেশে
বাংলাদেশে উৎপাদিত বিস্কুট যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, নেপালসহ ৩০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ৫ বছর আগে এই রপ্তানি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি বিস্কুটের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিস্কুট, ওয়েফার ও কেক রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩৬৮ কোটি ৫ লাখ টাকা আয় করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিস্কুটের রপ্তানি বাজার ৫০০ কোটি ছাড়ায়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিস্কুট রপ্তানি প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।