করোনায় মালিকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেই ক্ষতি পোষানোর বহুমুখী তৎপরতার কারণে নিয়ম লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ ওঠেছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে।
জানানো হয়েছে, সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নিলেও ৬৪টি কারখানার ২১ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও বহু মানুষকে ছাঁটাইয়ের তথ্য গোপন করা হয়েছে। ১৪ লাখ শ্রমিককে প্রণোদনা থেকে বেতন ভাতা দেয়া হয়নি।
এই শ্রমিক ছাঁটাইয়ে ও করোনা আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশ করা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, পোশাকখাত প্রণোদনার নামে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেলেও ক্ষতি পোষানোর এই বহুমুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে শ্রমিকদের সেই সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে অধিকাংশ মালিক।
এর ফলে খাতসংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ শ্রমিক করোনায় আর্থিক ও মানবিক সংকটে পড়েছে। এতে প্রায় ৭৭ শতাংশ শ্রমিক তাদের পরিবারের সব সদস্যের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না।
‘তৈরি পোশাক খাতের করোনা ভাইরাস উদ্ভূত সংকট : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সব ধরনের সুবিধা পাওয়ার পরও একের পর এক বন্ধ হয়েছে পোশাক কারখানা। খাতজুড়ে ছাঁটাই আতঙ্ক তৈরি করে কমানো হয়েছে শ্রমিকদের বেতন।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সংগঠনের দুই জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ ফোন ধরেননি।
গত মার্চ করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সরকার ১৪ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে পোশাক খাত।
এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা বলছে সরকার। আর পোশাক মালিকরা আবার প্রণোদনার দাবি করছেন।
টিআইবি বলছে, প্রণোদনার অর্থ মালিকরা বেতন-ভাতার জন্য নিলেও এখনও সেই অর্থ থেকে বেতন পায়নি ১৪ লাখ বা ৪২.০২ শতাংশ শ্রমিক। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কর্মকাণ্ডেও ছিল মালিকদের ব্যাপক উদাসিনতা।
কিছু ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গ থাকা শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি দেয়ার বদলে ছাঁটাই করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিনা কারণে ছাঁটাই করা এবং কাজে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
টিআইবি বলেছে, লে-অফ ঘোষণা করা কারখানার শ্রমিকদের এপ্রিলে ৬৫ শতাংশ বেতন দেয়ার অঙ্গীকার করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি।
লে-অফ ঘোষণার কারণে এক বছরের কম সময় কর্মরত অনেক শ্রমিক কোনও সুবিধা ছাড়া চাকরি হারান। এতে কিছু কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
আবার অনেক কারখানা ঈদ পরবর্তী ছয় মাসেও ঈদ বোনাসের বাকি অর্ধেক পরিশোধ করেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারখানা অগ্রিম নোটিশ না দিয়ে অর্ডার বাতিল করার অজুহাতে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব কারখানায় শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকা প্রণয়ন সরকার ও মালিকপক্ষের সংগঠনগুলোর অনাগ্রহ এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুবিধাভোগী প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল থেকে সামাজিক সুরক্ষা সহায়তা এখনও পায়নি।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন ও ঈদ বোনাসের যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ কম পেয়েছে।
বাতিল হওয়া প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যাদেশ পুনর্বহাল হলেও বিজিএমইএ তা স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রকাশে করেনি। শুধু তাই নয়, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে কারখানা হতে প্রাপ্ত তথ্য বাতিল করা কার্যাদেশের পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে।
বৈষম্য প্রণোদনার অর্থ বিতরণেও
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রণোদনার অর্থপ্রাপ্তিতে বড় কারখানাসমূহকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও তদবিরে। এ ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসায়ীরা সুবিধা কম পেয়েছে।
ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতেও ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ ছিল। এদের টাকা পরিশোধে এক বছর সময় নির্ধারণ করা হলেও বড় ব্যবসায়ীদের জন্য টাকা পরিশোধে দুই বছর নির্ধারণ করা হয়।
আবার লে-অফ ঘোষিত কারখানাসমূহ সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পাবে না বলে নির্দেশনা এলেও মালিকপক্ষের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংককে সরে আসতে দেখা গেছে।
৯ সুপারিশ
১. করোনা মহামারি বিবেচনায় নিয়ে সব শ্রমিকের চাকুরির নিরাপত্তার বিধান সংযুক্ত করে ‘শ্রম আইন, ২০০৬’ এর ধারা ১৬ এবং ধারা ২০ সংশোধন করতে হবে।
২. শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ ও স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে ইউটিলাইজেশন ডিকেয়ারেশন সুবিধা বাতিল ও জরিমানার ব্যবস্থা করা।
৩. বিজিএমইএর অঙ্গীকার করা করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বাকি তিনটি ল্যাব সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দ্রুততার সঙ্গে স্থাপন।
৪. ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিক ব্যবসা পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। পোশাকের ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ ও কার্যাদেশের বিদ্যমান শর্তের সঙ্গে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয় সংযুক্ত করা।
৫. শ্রমিক অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নিয়মিত ও কার্যকর পরিদর্শন নিশ্চিত করা।
৬. লে-অফ করা কারখানায় এক বছরের কম কর্মরত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭. করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, কার্যাদেশ বাতিল ও পুনর্বহাল, প্রণোদনার অর্থের ব্যবহার ও বণ্টন, ইত্যাদি সব তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে; এসব তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা।
৮. ইইউ ও জার্মানির সহায়তা তহবিল ব্যবহারের জন্য করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সঠিক তালিকা অবিলম্বে প্রণয়ন।
৯. করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকার ও মালিক সংগঠনসমূহ কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটিকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা।